আমরা সকলেই জীবনে সাফল্য আর স্থিতিশীলতা চাই। কিন্তু এর পেছনে কাজ করে আমাদের মানসিক শক্তি, যা কেবল আমরা কী করি তার মধ্যে দিয়ে নয়, বরং আমরা কী করি না তার মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয়। মানসিক দৃঢ়তা মানেই কেবল কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা নয়, এটি হলো নিজেকে এমন কিছু নেতিবাচক অভ্যাস থেকে দূরে রাখা, যা আপনার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। গবেষকদের মতে, মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা ১৩টি নির্দিষ্ট কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখেন, যা তাদের সাফল্যের পথকে প্রশস্ত করে।
১. নিজেদের দুর্দশার জন্য দুঃখবোধে সময় নষ্ট করেন না:
মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা বোঝেন যে, নিজের জন্য দুঃখবোধ করা আত্মবিনাশী। এতে জীবনের ভালো দিকগুলো উপভোগ করা যায় না, সময় নষ্ট হয়, নেতিবাচক আবেগ সৃষ্টি হয় এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই তারা সবসময় জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো খোঁজেন এবং যা আছে তার মূল্যায়ন করতে শেখেন। কৃতজ্ঞতাবোধের মাধ্যমে তারা দুঃখবোধকে বিতাড়িত করেন।
২. নিজেদের হাল ছেড়ে দেন না:
যখন শারীরিক বা আবেগগতভাবে অক্ষম মনে হয়, তখনই মানুষ হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষরা সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে উঠে দাঁড়ান। তারা নিজেদের জন্য একটি সীমা টানতে জানেন এবং নিজেদের তৎপরতার নিয়ন্ত্রণ অন্য কারো হাতে তুলে দেন না, কারণ তারা জানেন, নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে থাকলে তারাই আপনার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ধারণ করে দেবে।
৩. পরিবর্তনে লজ্জিত হন না:
পরিবর্তন জীবনের এক অনিবার্য অংশ। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা পরিবর্তনের পাঁচটি ধাপ—প্রাক-চিন্তা, চিন্তা, প্রস্তুতি, তৎপরতা এবং তা বজায় রাখা—সবকিছুই গুরুত্ব দেন। পরিবর্তন অনেক সময় ভয়ের কারণ হতে পারে, কিন্তু পরিবর্তনের প্রতি অনাগ্রহ আপনাকে পিছিয়ে দেবে। যত দেরি করবেন, ততই তা কঠিন হবে এবং অন্যরা আপনাকে ছাড়িয়ে যাবে।
৪. অনিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয়ে মনোযোগ দেন না:
সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকলে নিরাপদ মনে হলেও, আমরা চাইলেই সব সময় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা মূলত উদ্বেগের লক্ষণ। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা বরং নিজেদের উদ্বেগ সামলানো এবং নিজেদের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এতে সুখ বাড়ে, মানসিক চাপ কমে, সম্পর্ক উন্নত হয়, নতুন সুযোগ তৈরি হয় এবং বেশি সাফল্য আসে।
৫. সকলকেই খুশি করতে চান না:
নিজের মূল্যায়ন অন্যের মতামতের ওপর ভিত্তি করে করা মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ। অনবরত অন্যদের খুশি করার চেষ্টা করলে চারটি দিক থেকে ক্ষতি হয়: সময় নষ্ট হয়, সহজেই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অন্যের জন্য রাগ বা হতাশ বোধ করতে পারেন এবং সর্বোপরি, আপনি কখনোই সকলকে খুশি করতে পারবেন না। এই মানসিকতা ত্যাগ করতে পারলে আপনি আরও শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী হবেন।
৬. ঝুঁকি নিতে ভয় পান না:
অজ্ঞতার কারণেই মানুষ ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। ঝুঁকির পরিমাণ পরিমাপ করার জ্ঞানের অভাবই ভয়ের কারণ। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা ঝুঁকি বিশ্লেষণের জন্য নিজেদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেন, যেমন: এই ঝুঁকির সম্ভাব্য ক্ষতি কী? উপকারিতা কী? নিজের লক্ষ্য অর্জনে এটি কীভাবে সহায়তা করবে? এর বিকল্পগুলো কী? সবচেয়ে বাজে পরিণতি কী হতে পারে এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায়? আগামী পাঁচ বছরে এই সিদ্ধান্ত কী ফল বয়ে আনবে?
৭. অতীতে বাস করেন না:
যা ঘটে গেছে, তা কখনোই বদলানো সম্ভব নয়। অতীতে বাস করা আত্মবিনাশী, যা বর্তমানকে উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত করে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বাধা দেয়। এতে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না এবং বিষণ্নতা বাড়ায়। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা বরং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান।
৮. একই ভুল বারবার করেন না:
নিজের ভুলগুলোর দায় গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতে একই ভুল এড়াতে সুচিন্তিত পরিকল্পনা তৈরি করা মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষের বৈশিষ্ট্য। তারা ভুল থেকে শেখেন এবং সামনে এগিয়ে যান।
৯. অন্যদের সাফল্য দেখে ক্ষুব্ধ হন না:
অন্যের সাফল্য দেখে ঈর্ষান্বিত হলে তা আপনার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং নিজের লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ নষ্ট করে। আপনি সফল হলেও সুখী হতে পারবেন না যদি সবসময় অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামান। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা নিজের সম্ভাবনাকে দেখতে পান এবং নিজের মূল্যবোধ ও সম্পর্কগুলো রক্ষা করেন।
১০. প্রথমবার ব্যর্থ হলেই হাল ছেড়ে দেন না:
সাফল্য এত সহজে ধরা দেয় না। ব্যর্থতা অতিক্রম করেই সামনে এগোতে হয়। ব্যর্থতাকে অগ্রহণযোগ্য ভাবা এবং নিজেকে অযোগ্য মনে করা মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ। বরং একবার ব্যর্থ হয়ে পুনরায় ফিরে দাঁড়ালে আপনি আরও শক্তিশালী হবেন।
১১. একাকী থাকতে ভয় পান না:
নিজের চিন্তা নিয়ে একাকী সময় কাটানো এক শক্তিশালী অভিজ্ঞতা হতে পারে, যা লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক। মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে প্রতিদিনের ব্যস্ততার বাইরেও নিজের জন্য একাকী সময় বের করে উন্নতিতে মনোযোগ দিতে হয়। একাকিত্ব উৎপাদনশীলতা, সহানুভূতি এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধার করে।
১২. মনে করেন না যে দুনিয়াটা তাদের কাছে ঋণী:
নিজের ব্যর্থতা বা স্বল্প সাফল্যের কারণে রাগান্বিত হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও, সত্য হলো কোনো সাফল্য আপনাআপনি ধরা দেয় না, তা অর্জন করতে হয়। অন্যরা আপনার চেয়ে বেশি সফল হলে ভাববেন না যে আপনার সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে। জীবনে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো, নিজের প্রচেষ্টায় মনোযোগ নিবদ্ধ করা, সমালোচনা গ্রহণ করা এবং নিজের ভুলগুলো স্বীকার করা। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করা শুধু হতাশা বাড়ায়।
১৩. তাৎক্ষণিক ফল আশা করেন না:
নিজের সম্ভাবনার চূড়ায় পৌঁছাতে হলে বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখুন। মনে রাখবেন, সাফল্য রাতারাতি আসে না। মানসিকভাবে দুর্বল মানুষরা প্রায়শই অধৈর্য হয়ে পড়েন এবং নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে অতিমূল্যায়ন করে বসেন। তারা বোঝেন না যে, কোনো টেকসই পরিবর্তন আসতে দীর্ঘ সময় লাগে, ফলে তাৎক্ষণিক ফল লাভের আশা করেন। মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষেরা ধীরস্থিরভাবে নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন।
এই ১৩টি ‘না’ মেনে চলার মাধ্যমে আপনিও নিজের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেন এবং সাফল্যের পথে আরও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারেন।