একসময় বাঙালির রান্নাঘরের অবিচ্ছেদ্য অংশ সরিষার তেল তার ঐতিহ্যবাহী স্থান হারিয়েছে, আর সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে সয়াবিন তেল। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যমুখী তেল বা অলিভ অয়েলের মতো উচ্চমূল্যের বিকল্পও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু কোন তেল সত্যিই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য সেরা? এই বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন বিভাগের চীফ কনসালটেন্ট, পুষ্টিবিদ সামিরা খালেক সুকৃতি, যার বিশ্লেষণ তেল ব্যবহারের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
পুষ্টিবিদ সামিরা খালেকের প্রধান দাবি, “আমাদের দেশে যত ধরনের ভোজ্যতেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো সরিষার তেল।” এই দাবির পেছনে তার মূল যুক্তি হলো, ভেজালের সুযোগ। তিনি উল্লেখ করেন, সয়াবিন এবং সানফ্লাওয়ার অয়েলের মতো তেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা পাম অয়েলসহ বিভিন্ন সস্তা উপাদান মেশাতে পারে। কিন্তু সরিষার তেলে এমন কিছু মেশালে তা ভালোভাবে মিশ্রিত হয় না, ফলে ভেজালের সম্ভাবনা কমে যায়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, বিশেষত যখন বাজারের বেশিরভাগ ভোজ্য তেল নিয়ে বিশুদ্ধতার প্রশ্ন ওঠে।
ক্যালরির দিক থেকে সব তেল প্রায় সমান হলেও, পুষ্টিবিদ জোর দিয়েছেন ফ্যাটের গুণমানের উপর। তিনি বলেন, এক গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ ক্যালরি পাওয়া যায়। তবে মূল পার্থক্য হলো স্যাচুরেটেড এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রায়। এই দিক থেকে সরিষার তেল সয়াবিনের চেয়ে এবং অলিভ অয়েল আরও উন্নত, যা আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যকর হিসেবে সুপরিচিত হলেও, এর ব্যবহার নিয়ে একটি বড় ভুল ধারণা প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন, অলিভ অয়েল দিয়ে সব ধরনের রান্না স্বাস্থ্যকর হবে। কিন্তু সামিরা খালেক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “যখন আপনি অলিভ অয়েল বেশি তাপে রান্না করবেন, গুণগত মান নষ্ট হবে।” অতিরিক্ত তাপ অলিভ অয়েলের সংবেদনশীল আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলোকে ভেঙে দেয়, যা এর কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিগুণ হ্রাস করে। এটি সালাদে বা হালকা রান্নায় উপযুক্ত হলেও, গভীর তেলে ভাজার জন্য আদর্শ নয়।
ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি রান্নায় তেল ও মসলার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি। এই প্রবণতার কারণে সয়াবিন তেলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। পুষ্টিবিদ পরামর্শ দিচ্ছেন যে, সরিষার তেল পরিমাণে কম লাগে, যা ক্যালরি গ্রহণ কমাতে সাহায্য করে। এই পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একদিকে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যভ্যাসের সাথে আধুনিক পুষ্টিজ্ঞানের সেতুবন্ধন ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ঝুঁকি কমাচ্ছে।
পুষ্টিবিদ সামিরা খালেকের এই বিশ্লেষণ আমাদের ভোজ্য তেল ব্যবহারের অভ্যাসকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ভেজালের ঝুঁকি, ফ্যাটের গুণমান এবং রান্নার পদ্ধতি – এই সব বিষয় মাথায় রেখে সঠিক তেল নির্বাচন এবং সচেতন ব্যবহারই সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। সরিষার তেলকে ‘সেরা’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা কেবল ঐতিহ্য নয়, আধুনিক স্বাস্থ্য চেতনারও প্রতিফলন। এই তথ্যগুলি সাধারণ মানুষকে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে আরও সচেতন হতে সাহায্য করবে।