নারীর জীবনে ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য প্রক্রিয়া হলেও, এর সঙ্গে যুক্ত শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জগুলো প্রায়শই দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। মাসিকের আগে ও চলাকালীন পেটে ক্র্যাম্প, কোমর ও তলপেটে ব্যথা, পেট ফাঁপা, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা এবং ক্লান্তি – এই সমস্যাগুলো বহু নারীর কাছেই পরিচিত। যদিও ব্যথানাশক বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের মতো ওষুধ এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সাম্প্রতিক গবেষণা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ব্যায়ামই হতে পারে এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার এক কার্যকরী এবং প্রাকৃতিক উপায়।
ব্যথা উপশমে ব্যায়ামের ভূমিকা: পিরিয়ডের সময় ক্র্যাম্প বা অসহনীয় ব্যথা বহু নারীর দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। এই ব্যথা তলপেট থেকে শুরু হয়ে উরু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুসংবাদ হলো, নিয়মিত ব্যায়াম এই ক্র্যাম্প কমাতে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও, ছোট ছোট গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যায়াম ‘প্রাথমিক ডিসমেনোরিয়া’ (পিরিয়ডের ব্যথা) কমাতে এবং উল্লেখযোগ্য উপশম দিতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরচর্চা রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে এবং প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা নিরসনে সাহায্য করে।
মেজাজ উন্নত করে, চাপ কমায়: আমেরিকান কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট (ACOG) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, ব্যায়াম পিরিয়ডের সময় মেজাজকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে এবং মানসিক চাপ কমাতে পারে। হেলথকেয়ার জার্নালে প্রকাশিত ২০২৪ সালের সৌদি আরবের একটি গবেষণা এই দাবিকে সমর্থন করে। ১২-১৮ বছর বয়সী কিশোরীদের মাসিকের স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন ধরণের ব্যায়ামের প্রভাব নিয়ে করা এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, সপ্তাহে তিনবার ২০-৩০ মিনিটের ব্যায়াম শুধুমাত্র পিরিয়ডের ব্যথা কমাতেই নয়, বরং মানসিক চাপ কমাতেও কার্যকর। গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, অ্যারোবিক এবং স্ট্রেচিং ব্যায়ামের সংমিশ্রণ পিরিয়ডের ব্যথা সবচেয়ে বেশি হ্রাস করেছে, যেখানে শুধুমাত্র স্ট্রেচিং ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
পেট ফাঁপা কমানো: মাসিক চলাকালীন পেট ফাঁপা বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাতেও ব্যায়াম উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। যেসব নারী নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গবেষণা বলছে, নাচ এবং সাইকেল চালানোর মতো অ্যারোবিক ব্যায়াম খিঁচুনি এবং পেট ফাঁপার মতো সমস্যার তীব্রতা কমাতে পারে। কারণ এই ধরনের ব্যায়াম রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করে, অ্যালডোস্টেরনের মাত্রা কমায় (একটি হরমোন যা শরীরকে লবণ এবং জল ধরে রাখার সংকেত দেয়) এবং মানসিক চাপ হ্রাস করে, যা সবই পেট ফাঁপার সমস্যাকে প্রভাবিত করে।
উন্নত ঘুম ও বর্ধিত শক্তি: কুরিওস জার্নালে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা অনুসারে, মাসিক চক্র নারীর ঘুম এবং হৃদরোগের স্বাস্থ্য উভয়কেই প্রভাবিত করে, যা ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনের মাত্রার পরিবর্তনের কারণে ঘটে। ব্যথা, অস্বস্তি এবং মানসিক চাপের সঙ্গে এই হরমোনের পরিবর্তন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ব্যায়াম এই ঝুঁকিগুলো হ্রাস করতে পারে, পিরিয়ডের সময় ক্র্যাম্প কমিয়ে এবং ঘুমের মান উন্নত করে।
এছাড়াও, পিরিয়ডের সময় বেশিরভাগ নারী শক্তির স্তরে কিছু পরিবর্তন অনুভব করেন, যা মূলত হরমোনের মাত্রার ওঠানামার কারণে হয়। তবে, এর অর্থ এই নয় যে শরীরচর্চা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সক্রিয় থাকলে তা মেজাজ উন্নত করতে এবং শক্তির মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে, যা ঋতুস্রাবকালীন ক্লান্তির মোকাবিলায় সহায়ক।
সুতরাং, ব্যথানাশকের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিয়মিত ব্যায়ামকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তোলাই ঋতুস্রাবকালীন সমস্যা সমাধানের এক কার্যকর পথ হতে পারে।