নারীঘটিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম। এই রোগে মধ্যবয়সীরা নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক বিবাহিত তরুণীর ক্ষেত্রেও এই সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগ হলে অবহেলা ও কালক্ষেপণ করা যাবে না। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম মূলত নারীদেহে এন্ড্রোজেন (পুরুষ যৌন হরমোন)-এর আধিক্যের কারণে সংঘটিত শারীরিক সমস্যা।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের বেশ কিছু উপসর্গ রয়েছে। যেমন-
ক. অনিয়মিত মাসিক
খ. অতিরিক্ত রক্তস্রাব
গ. মুখে ও শরীরে অত্যধিক লোম (পুরুষালি)
ঘ. ব্রণ মুখে ও শরীরের অন্যান্য অংশে।
আরও কিছু শারীরিক সমস্যা এর সঙ্গে যোগ হতে পারে- তলপেটে ব্যথা, মকমলেরমতো কালো ত্বক (ঘাড়, বগল ইত্যাদি জায়গায়), বন্ধ্যত্ব।
এ রোগীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এদের অনেকেই দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত হন, নাকডাকা ও ঘুমের সময় হঠাৎ করে শ্বাস বন্ধ হওয়া, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম একটি জীনগত ত্রুটি ও পরিবেশগত ত্রুটির সমন্বিত ফল। জীনগত ত্রুটি আছে এমন কিশোরীর দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, খুব কম শারীরিক শ্রম সম্পাদন করা ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ করা ইত্যাদি এ রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম দেখা দেয় যখন, ডিম্বাশয় অতিরিক্ত পরিমাণে টেস্টোস্টেরন হরমোন তৈরি করতে উদ্দীপ্ত হয়। যার পিছনে পিটুইটারি গ্রন্থি কর্তৃক অতিরিক্ত এলএইচ (LH) নিঃস্বরণ ও দেহে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্সের উপস্থিতি।
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম নাম হওয়ার প্রধান কারণটি হলো, এ রোগিনীদের ডিম্বাশয়ে বিভিন্ন বয়সি, বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন সংখ্যার সিস্ট থাকতে পারে। কিন্তু এটি পরিষ্কারভাবে একটি হরমোনজনিত সমস্যা। অধিকাংশ রোগীর দেহে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্স থাকে এবং তারা স্থূলকায়া হয়।
লক্ষণ
অনিয়মিত মাসিক : বেশিরভাগ মেয়েদের ৪০ বা ৪৫ বা ৫০ দিন বা কারও কারও ক্ষেত্রে আরও বেশি দিন পর ঋতুস্রাব হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় ঋতুস্রাব হতে পারে, কারও কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঋতুস্রাব হয়। মাসের পর মাস ঋতুস্রাব বন্ধ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতেই এ সমস্যা শুরু হতে পারে, প্রজননক্ষম সময়ে অন্য যেকোনো সময়েও এ সমস্যা শুরু হতে পারে।
বন্ধ্যত্ব : যতজন নারী সন্তান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের কারণে হয়। এ বন্ধ্যত্বের কারণ হলো- ঋতুচক্রের অনেকগুলোতেই ডিম্বাণুর অনুপস্থিতি।
পুরুষালি হরমোনের আধিক্য: পুরুষালি হরমোনের অধিক মাত্রায় উপস্থিতিও এর বহিঃপ্রকাশ। এর ফল স্বরূপ নারী দেহে পুরুষদের মতো লোম দেখা দিতে পারে (হার্সোটিজম), মুখে বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় ব্রণ হওয়া, পুরুষালি টাক ইত্যাদি। প্রতি চারজন পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের নারীর তিনজনের দেহে এ লক্ষণগুলো থাকে।
মেটাবলিক সিন্ড্রোম : এতে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীর দেহে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্সের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে- ক্রমশ দৈহিক ওজন বৃদ্ধি হওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, দুর্বলতা, স্মৃতিশক্তি দুর্বলতা, ঘাড়ের পিছনে বা বগলে নরম কালো ত্বকের উপস্থিতি, রক্তের গ্লুকোজ কিছুটা বেড়ে যাওয়া, কলেস্টেরল অস্বাভাবিক থাকা ইত্যাদি।
রোগ শনাক্তকরণ
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম শনাক্ত করতে সচরাচর নিম্নলিখিত ক্রাইটেরিয়ার যে কোনো দুটির উপস্থিতি আবশ্যক-
* নারীদেহে অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন উপস্থিতির প্রমাণ।
* অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
* ডিম্বাশয়ে সিস্ট।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
* সিরাম টেস্টোস্টেরন, এলএইচ, এফএসএইচ।
* পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম।
* ওজিটিটি।
চিকিৎসা
জীবন-যাত্রা ব্যবস্থাপনা
চিকিৎসার শুরুতেই খাদ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থাপনা রোগিনীর দৈহিক ওজন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে, বিপাকীয় প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটাবে যাতে করে ইনস্যুলিন রেজিস্ট্রেন্স কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আদর্শ জীবন-যাপন ব্যবস্থাপনা রোগিনীর হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমাবে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের খাদ্য তালিকায় শর্করার আধিক্য কম থাকবে, শকসবজি (আলু বাদে), রঙিন ফলমূল ও আমিষজাতীয় খাদ্য প্রাধান্য পাবে। দৈহিক ওজন বডি এমআই বিবেচনায় রেখে শারীরিক শ্রমের ব্যবস্থা করতে হবে।
চিকিৎসা
* নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রের জন্য ব্যবহৃত পিলগুলো যাতে স্বল্প মাত্রায় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্ট্রেরন থাকে, তা খুব সহায়ক ওষুধ।
* মেটফরমিন
* অবাঞ্ছিত লোম দূর করবার ক্রিম
* প্রজনন সম্ভাবনা বৃদ্ধির ওষুধ
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত নারীদের অধিকাংশই এ সমস্যার শারীরিক লক্ষণগুলোকে খুব দ্রুত বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ লক্ষণগুলো বুঝতে পারলেও সংকোচ বোধের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করেন। যেহেতু রোগটির ব্যাপকতা ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে, তাই প্রজননক্ষম বয়সের সব নারীকে তার এ সমস্যা আছে কিনা জানার জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।