মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যখন যুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন এক চাঞ্চল্যকর দাবি নিয়ে সামনে এসেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তাঁর দাবি, ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ আসলে কোনো দেশের সঙ্গে দেশের যুদ্ধ নয়, এটি একটি ‘শেষ যুদ্ধ’, যার অবসান হতে পারে একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করার মাধ্যমে: ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই। নেতানিয়াহুর এই বক্তব্য শুধু কূটনৈতিক মহলেই নয়, বিশ্বের তাবৎ পর্যবেক্ষকদের মনে নতুন করে প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে — কে এই খামেনেই, যাঁর জীবনাবসান নাকি মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের সংঘাতের চিরস্থায়ী সমাধান এনে দেবে?
নেতানিয়াহুর ‘টার্গেট খামেনেই’ তত্ত্ব
ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরাসরি ঘোষণা করেছেন যে, ইজরায়েলের লক্ষ্য ইরানের সঙ্গে কোনো সর্বাত্মক যুদ্ধ নয়, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের প্রচেষ্টা। তাঁর বিস্ফোরক দাবি, “আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইকে হত্যা করতে পারলেই যুদ্ধ মিটে যাবে।” এই দাবি এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে: একজন ব্যক্তির মৃত্যু কীভাবে দুটি জাতির মধ্যে দশকব্যাপী সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারে? নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইজরায়েল খামেনেইকেই এই অঞ্চলের অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কে এই আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই?
নেতানিয়াহুর কথার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কে এই আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই, যাঁর ওপর এত বড় দাবি বর্তেছে? কেন তাঁর অনুপস্থিতিই একটি দেশকে চিরতরে যুদ্ধমুক্ত করতে পারবে?
আয়াতোল্লাহ সাইয়্যেদ আলি খামেনেই, বর্তমানে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা (Supreme Leader) পদে আসীন। তিনি কেবল দেশটির রাজনৈতিক প্রধানই নন, ধর্মীয়ভাবেও দেশের সবচেয়ে বড় কর্তৃত্ব। ইরানে তাঁর নির্দেশ ছাড়া একটি পাতাও নড়ে না, এমনটাই প্রচলিত।
এক ধর্মগুরুর শীর্ষতম নেতা হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য পথচলা
১৯৩৯ সালে ইরানের মাশহাদ শহরে জন্ম নেওয়া আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই ছোটবেলা থেকেই ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং শিয়া মতবাদের একজন ধর্মগুরু হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে ইরানে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময়। তিনি ছিলেন ১৯৭৯ সালের ইরানি ইসলামি বিপ্লবের প্রধান নেতা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
খোমেইনির নেতৃত্বে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির রাজতন্ত্র উৎখাত হলে ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন শাসনব্যবস্থায় খামেনেই ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, এর আগে ছিলেন সংসদ সদস্য (মজলিস)। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি খোমেইনির প্রতিনিধি হিসেবে সেনাবাহিনীতে কার্যত তদারকির কাজ করতেন। যদিও সে সময় তাঁর ধর্মীয় পদমর্যাদা ছিল ‘হোজ্জাতুল ইসলাম’—অর্থাৎ তখনও তিনি শীর্ষস্থানীয় আয়াতোল্লাহর পর্যায়ে পৌঁছননি।
নাটকীয় মোড়: খোমেইনির মৃত্যু এবং সংবিধান বদল
১৯৮৯ সালে আয়াতোল্লাহ খোমেইনির মৃত্যু হয়। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে আগে থেকেই মনোনীত ছিলেন আয়াতোল্লাহ হোসেইন আলি মোন্তাজেরি। কিন্তু খোমেইনির সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই নাটকীয় মুহূর্তে ইরানের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস’ নতুন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করতে বসে। সেখানে অস্থায়ীভাবে খামেনেইকে নেতা হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়, যদিও তিনি তখনও ধর্মীয় যোগ্যতা অনুযায়ী শীর্ষ নেতার শর্ত পূরণ করতেন না। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের সংবিধান বদলে দেওয়া হয়, যাতে সর্বোচ্চ নেতার ক্ষেত্রে ‘মারজায়ে তাকলিদ’ (সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যাখ্যাতা) হওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়। এই সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই খামেনেই স্থায়ীভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে যান—এক অপ্রত্যাশিত উত্থান!
সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা: রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, সর্বোচ্চ নেতা হচ্ছেন দেশের প্রকৃত শাসক। প্রেসিডেন্ট ও সংসদ থাকলেও তাঁদের সকল কার্যকলাপের ওপর নজর রাখেন খামেনেই। তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন:
সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC)
বিচারব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থা
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন
বিদেশনীতি ও পরমাণু কর্মসূচি
নির্বাচন প্রক্রিয়া ও প্রার্থীদের অনুমোদন
এছাড়াও, তিনি দেশের শীর্ষ বিচারপতি, রক্ষণশীল ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’-এর অর্ধেক সদস্য এবং শুক্রবারের নমাজের ইমামদেরও মনোনয়ন দেন। অর্থাৎ, ইরানের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে হয়।
বিতর্ক ও কঠোর শাসনের অভিযোগ
আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইয়ের শাসনকালে ইরানে বহুবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালের ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ আন্দোলন বা ২০২২ সালের ‘মাহসা আমিনি’ বিক্ষোভ—সব ক্ষেত্রেই সরকারের কঠোর দমননীতি সামনে এসেছে। ধারণা করা হয়, খামেনেই নিজেই এসব দমননীতির নির্দেশদাতা। নির্বাচনের আগে তিনি সংস্কারপন্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করেও সমালোচিত হয়েছেন।
একদিকে ধর্মীয় নেতা, অন্যদিকে কুশলী রাষ্ট্রনায়ক, আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই একাধারে বিপ্লবের সময়কার আনুগত্য এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার দক্ষ বিন্যাসের মাধ্যমে নিজের এই অবস্থানে এসেছেন। সংবিধান বদলে নিজের পক্ষে পরিস্থিতি আনা, শীর্ষ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং দীর্ঘদিনের কঠোর শাসনের মাধ্যমে তিনি এখন ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী নেতা। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্তব্য যদি সত্যি হয়, তাহলে আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য অনেকটাই নির্ধারিত হতে পারে এই একজন ব্যক্তির ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করে।