মেটিয়াবুরুজের রবীন্দ্রনগরে শিব মন্দিরে সাম্প্রতিক ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আবারও উত্তেজনার পারদ চড়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) আজ নিজাম প্যালেসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবক্ষয়েরই ফল।
শুভেন্দু অধিকারী বিস্ফোরক মন্তব্য করে বলেন, “এই রাজ্য সরকার মানুষের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করে, এদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হোক।” তিনি আরও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে, “তৃণমূল সুপ্রিমোর সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে দেখা হবে।”
শুভেন্দুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ‘তোষণ’ অভিযোগ
কলকাতা হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে গতকাল (১৭ জুন) শুভেন্দু অধিকারী ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পরিদর্শনে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখেন। তাঁর মতে, এই ঘটনা হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর একটি ‘পরিকল্পিত আক্রমণ’ এবং এর জন্য তিনি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ‘তোষণ নীতি’কে দায়ী করেন। তাঁর অভিযোগের সমর্থনে তিনি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায়ের কথাও উল্লেখ করেন, যা তাঁর মতে ‘মুসলিম তোষণ নীতির’ বিরুদ্ধে এক উপযুক্ত রায়।
গত ১১ জুন, মেটিয়াবুরুজের রবীন্দ্রনগরে অবস্থিত শিব মন্দিরে দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনায় মন্দিরের পবিত্র তুলসীমঞ্চ ভেঙে ফেলা হয় এবং অন্যান্য অংশেও ক্ষতিসাধন করা হয়। এই ঘটনা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, হাইকোর্টের শর্তসাপেক্ষ অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
নিজাম প্যালেসে সাংবাদিকদের সামনে শুভেন্দু বলেন, “মেটিয়াবুরুজের শিব মন্দিরে ভাঙচুর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির উপর আক্রমণ।” রাজ্যে গণতন্ত্র নেই অভিযোগ করার সময় তিনি আরও বলেন, “যে ব্যবসায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করেছিল, গিয়ে দেখুন তিনি আদৌ জীবিত আছেন কিনা।”
তাঁর দাবি, এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা, যার পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে। “তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করে ধর্মীয় স্থানগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে,” তিনি যোগ করেন। তাঁর আরও অভিযোগ, পুলিশ এই ঘটনায় তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছে না এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মহেশতলা থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা ‘রাজ্য স্পনসর্ড’ এবং রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘তোষণের রাজনীতি’ চলছে।
এনআইএ তদন্তের দাবি ও তৃণমূলের পাল্টা জবাব
শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনায় জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) দ্বারা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রমাণ। আমরা চাই এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। এনআইএ তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার পিছনের ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হবে।”
তিনি আরও দাবি করেন যে, মেটিয়াবুরুজের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাজ্যে ধর্মীয় স্থানগুলির উপর আক্রমণের ধারাবাহিকতার অংশ। গত ১৫ জুন, শুভেন্দু মেটিয়াবুরুজের অশান্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত ২৩টি পরিবারকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন এবং এই ঘটনায় এনআইএ তদন্তের দাবি জানান। তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা বিজেপির পক্ষ থেকে তাদের সাহায্য করছি এবং তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।”
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস শুভেন্দু অধিকারীর এই বক্তব্য ও পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, “শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে এই ঘটনাকে উসকে দিচ্ছেন।” তৃণমূল দাবি করেছে যে, রাজ্য সরকার সকল ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জনগণের প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
মেটিয়াবুরুজের রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দারা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ এবং আতঙ্কিত। একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “শিব মন্দির আমাদের সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। এটির উপর হামলা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। আমরা চাই প্রশাসন দ্রুত দোষীদের শাস্তি দিক।” আরেকজন বাসিন্দা শুভেন্দু অধিকারীর পরিদর্শনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “তাঁর এই সফর আমাদের আশা জাগিয়েছে। আমরা চাই এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।”
তবে, কিছু স্থানীয় বাসিন্দা মনে করেন, এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা বলেছেন, “আমরা শান্তি চাই। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত এই ঘটনাকে রাজনীতির বাইরে রেখে সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া।”
শুভেন্দু অধিকারী, যিনি ২০২১ সালে নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন, তিনি বিজেপির হয়ে রাজ্যে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে জোরদার করার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি তিনি রথযাত্রা এবং রাম নবমীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে হিন্দু ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। বুধবার আইসিসিআর-এ শতাধিক রথযাত্রা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে তিনি রথযাত্রার পথে গেরুয়া পতাকা দিয়ে সাজানোর আহ্বান জানান। এই প্রেক্ষাপটে, মেটিয়াবুরুজের ঘটনাকে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হিসেবে তুলে ধরে বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস মেটিয়াবুরুজে তাদের শক্তিশালী ভিত্তি ধরে রাখতে চাইছে। এই এলাকাটি তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা ও ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। শুভেন্দুর সফর ও বক্তব্যকে তৃণমূল এই অঞ্চলে বিজেপির প্রভাব বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করছে। ডায়মন্ড হারবারের পুলিশ সুপার বলেন, “আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করেছি এবং দোষীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।” তবে, শুভেন্দু অধিকারী পুলিশের তদন্তে ধীরগতি ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, “পুলিশ রাজনৈতিক চাপে কাজ করছে। আমরা রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছি।”
কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ঠিক আগের দিন নিজাম প্যালেসে শুভেন্দু অধিকারীর সাংবাদিক সম্মেলন রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়েছে। তিনি এই ঘটনাকে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে তুলে ধরে এনআইএ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
তৃণমূল এই অভিযোগকে রাজনৈতিক প্রচার হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা এখন শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রয়েছেন।