“পরমাণু খেলায় রাশিয়ার নতুন চাল”-ইরানের প্রকল্প তত্ত্বাবধানে পুতিনের প্রস্তাব, নজর গোটা বিশ্বের

যখন মধ্যপ্রাচ্য ইরান-ইজরায়েল সংঘাতে উত্তপ্ত, ঠিক তখনই এক নাটকীয় কূটনৈতিক চাল দিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বুধবার সেন্ট পিটার্সবার্গে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ইরানের পরমাণু প্রকল্পের কাজ তত্ত্বাবধান করতে আগ্রহী মস্কো, এবং এ ব্যাপারে তেহরানকে ইতিমধ্যেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পুতিনের এই প্রস্তাব, একইসঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে।

পুতিন স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরানের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো এবং তারা তেহরানকে প্রস্তাব দিয়েছেন যেন রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের কাজ চলে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “রাশিয়া ইরানের জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তেহরান যদি চায়, সেক্ষেত্রে ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত বেসামরিক ও শান্তিপূর্ণ খাতে ব্যবহারের ব্যাপারটি তত্ত্বাবধান করতে পারবে রাশিয়া। তবে অবশ্যই, তেহরান যদি চায়— কেবল তাহলেই এটা হতে পারে।”

এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি, পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে মস্কো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে প্রস্তুত।

পুতিন আরও জানান যে, ইরানের বন্দরশহর বুশেহেরে রাশিয়া দুটি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করছে এবং এই নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা তত্ত্বাবধান করছেন। এর থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়েছে এবং নেতানিয়াহু নাকি আশ্বাস দিয়েছেন যে বুশেহেরে নির্মিতব্য পারমাণবিক চুল্লি এলাকা ও তার আশেপাশে ইসরায়েল আঘাত করবে না। এটি রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করল, যেখানে তারা ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

চলমান ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে রাশিয়া ইরানকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে পুতিন সামরিক সহায়তার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “গত জানুয়ারিতে তেহরানের সঙ্গে মস্কোর কৌশলগত অংশীদারিত্ব সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয়েছে, কিন্তু সেখানে সামরিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারটি উল্লেখ নেই। তাছাড়া তেহরান এখনও অস্ত্র সহায়তার জন্য আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানায়নি।”

তবে পুতিন জোর দিয়েছেন একটি বৃহত্তর সমাধানসূত্রের ওপর। তিনি বলেন, “রাশিয়া মনে করে, বেসামরিক ও শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইরানের স্বার্থ রক্ষা করা এবং ইসরায়েলকে তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেওয়া— এ দু’টো ব্যাপার একই সঙ্গে এবং একই সময়ে সমাধান করা সম্ভব।” তিনি আরও জানান যে, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েলকে তাদের এই ‘চিন্তাভাবনার রূপরেখা’ পাঠিয়েছে।

রয়টার্স সূত্রে প্রাপ্ত পুতিনের এই মন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতা ভারসাম্যে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। একদিকে ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যেতে সহায়তা করার প্রস্তাব, অন্যদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনের চেষ্টা – রাশিয়ার এই দ্বিমুখী কৌশল বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেখানে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানে রাশিয়া নিজেকে একজন নিরপেক্ষ, কিন্তু প্রভাবশালী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই প্রস্তাব বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy