শহর যখন ক্রিসমাসের আলোকমালায় ঝলমল করছে, ঠিক তখনই গঙ্গার তীরে এক শান্ত, সমাহিত অথচ গভীর আধ্যাত্মিক আবহে পালিত হলো যীশুপুজো। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ‘যত মত তত পথ’ এই দর্শনকে পাথেয় করে বুধবার সন্ধ্যায় বেলুড় মঠে আয়োজিত হলো এই বিশেষ উপাসনা। কঠোর নিয়ম-অনুশাসন আর পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরাচরিত প্রথা মেনে যীশু খ্রিস্টকে আরাধনা করলেন মঠের সন্ন্যাসীরা।
আয়োজনে আড়ম্বর নয়, ছিল ভক্তির টান: সন্ধ্যা আরতির পর মূল মন্দিরের দক্ষিণ অংশে যীশু খ্রিস্টের সুসজ্জিত আলোকচিত্র স্থাপন করা হয়। তাঁর সামনে নিবেদন করা হয় ফুল, ফল, কেক এবং হরেক রকমের পেস্ট্রি। ধূপের সুগন্ধ আর মোমবাতির মৃদু আলোয় এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হয় মঠ প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানের শুরুতে মঠের সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীরা সমবেত কণ্ঠে ক্যারল সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পাশ্চাত্য সুর আর প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেখানে।
বাইবেল পাঠ ও সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা: প্রতি বছরের মতো এদিনও বাইবেল থেকে যীশু খ্রিস্টের জন্মকথা পাঠ করা হয়। উপস্থিত এক সন্ন্যাসী তাঁর ভাষণে বলেন, “যাঁর প্রেম সর্বজনের জন্য, তাঁর জন্মদিন কেবল নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের উৎসব নয়; এটি সমগ্র মানবসমাজের উৎসব।” রামকৃষ্ণ মিশনের এই ভাবধারা স্পষ্ট করে দেয় যে, শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে সব ধর্মই আসলে একই পরম সত্যের ভিন্ন ভিন্ন পথ।
ভক্তদের ঢল ও নিভৃত প্রার্থনা: এই বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে এদিন বেলুড় মঠে ভিড় জমিয়েছিলেন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। কেউ হাতজোড় করে প্রার্থনা করছিলেন, কেউ বা নিভৃতে ধ্যানমগ্ন। এক যুবকের কথায়, “এখানে এলে বোঝা যায় ধর্ম মানে বিভাজন নয়, বরং সংযোগ।”
বর্তমান সময়ে যখন বিভাজনের রাজনীতি মাথা চাড়া দিচ্ছে, তখন বেলুড় মঠের এই যীশুপুজো আসলে এক নীরব প্রতিবাদ। ঘৃণার বদলে ভালোবাসা আর সংঘাতের বদলে সহমর্মিতার যে শিক্ষা স্বামীজি দিয়ে গিয়েছেন, এই উৎসব তারই জীবন্ত প্রতিফলন। মোমবাতির আলোয় ভাসতে থাকা মঠ প্রাঙ্গণ যেন নিঃশব্দে মনে করিয়ে দিল— যীশু, রামকৃষ্ণ কিংবা বুদ্ধ, নাম আলাদা হলেও সত্যের পথ একই।