“আমার বাড়িতে ৪০টি তুলসীগাছ আছে, আমি জানি …”-কেন একথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা?

মহেশতলার সাম্প্রতিক হিংসাত্মক ঘটনা যেন কেবল একটি সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল না, বরং তা রাজ্যের রাজনীতিতে জন্ম দিল এক অভাবনীয় বিতর্কের – যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি ‘তুলসী গাছ’। ধর্মীয় পবিত্রতার এই প্রতীক এখন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্রের শাণপাথরে, যেখানে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী দল বিজেপি একে অপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে তীব্র বাক্যবাণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘৪০টি তুলসীগাছ’ থাকার দাবি থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘তুলসী মঞ্চ’ প্রোফাইল পিকচার – সব মিলিয়ে এই ‘তুলসী-রাজনীতি’ এখন বাংলার আলোচনার নতুন বিষয়।

অভিযোগ, মহেশতলায় একটি তুলসী গাছ বা মঞ্চ স্থাপনকে কেন্দ্র করেই নাকি অশান্তির সূত্রপাত। এই ঘটনার পরই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, তুলসী গাছকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানাতে শুরু করেন। শুভেন্দু অধিকারীর এক্স (আগে ট্যুইটার) হ্যান্ডেলের প্রোফাইল ছবি বদলে তুলসী মঞ্চের ছবি দেওয়া, এবং বিধানসভায় ‘তুলসী গাছের অবমাননা’ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের সোচ্চার অবস্থান বুঝিয়ে দেয়, এই ইস্যুকে তারা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। বিজেপির দাবি, মমতা সরকারের ‘সংখ্যালঘু তোষণের’ ফলেই নাকি হিন্দুদের পবিত্র গাছ তুলসীকে অসম্মান করা হচ্ছে। বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের অভিযোগ, বিধানসভায় বিজেপি বিধায়কদের গাড়ি তল্লাশি করা হচ্ছে, যা তাদের মতে, ‘কেউ যেন তুলসী গাছ নিয়ে বিধানসভায় না ঢোকে’, তার জন্যই সরকারের অনৈতিক পদক্ষেপ।

এই পরিস্থিতিতে নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সটান জানিয়ে দেন, “আমার বাড়িতে ৪০টি তুলসীগাছ আছে। আমি জানি, কোথায় তুলসী বসাতে হয়।” মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি একদিকে যেমন নিজের ধর্মভীরু ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা, তেমনই অন্যদিকে বিজেপির ‘হিন্দুত্ব কার্ড’কে পাল্টা আঘাত করার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।

রবীন্দ্রনগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে তুলসী গাছ হাতে বিজেপির বিক্ষোভের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তুলসী কয় রকমের হয় জানেন? তুলসীর মধ্যে লক্ষ্মীও আছে, নারায়ণও আছে। সব জায়গায় তুলসী গাছ লাগানো যায় না, সম্মানের সঙ্গে লাগাতে হয়। আমরা শ্রীকৃষ্ণকে তুলসী দিই, জগন্নাথকে তুলসী দিই।” এরপর নাম না করে শুভেন্দু অধিকারীকে আক্রমণ করে মমতা প্রশ্ন করেন, “আপনি নিজের বাড়িতে তুলসী গাছ লাগালেন না কেন? এভাবে দেবতাদের অসম্মান করা হয়, এগুলো অন্যায়। আজ দুর্গাপুজোর সময় অনেকে দেশের বাড়িতে যান। তাই বলে কি তার বাড়িটা আমি দখল করে নিতে পারি?”

তুলসী গাছ ঘিরে এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন বাংলার সংস্কৃতি ও রাজনীতির জটিল ছবি তুলে ধরছে। একদিকে যখন বিজেপি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভিত্তি মজবুত করতে চাইছে, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসও ধর্মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে। প্রশ্ন উঠছে, মহেশতলার একটি তুলসী গাছ ঘিরে যে অশান্তি, তা কি সত্যিই ধর্মভিত্তিক সংঘাতের ফল, নাকি এর আড়ালে রয়েছে গভীরতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য? ধর্মীয় প্রতীকের এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক ব্যবহার কি সমাজে বিভেদ বাড়াচ্ছে, নাকি এটি কেবলই নির্বাচনী প্রচারের নতুন কৌশল? এই তুলসী-যুদ্ধ যে আপাতত থামছে না, তা বলাই বাহুল্য।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy