সচরাচর আমরা ব্যথাকে শারীরিক আঘাত বা রোগের ফল হিসেবেই দেখি। কিন্তু হঠাৎ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে যে অচেনা ব্যথাগুলো আসে এবং দ্রুত চলে যায়, সেগুলোকে কি শুধু অবহেলা করা যায়? মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না। এই ‘অকারণ’ ব্যথাগুলোর নেপথ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের গভীর আবেগ আর মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। মনোবিজ্ঞানীরা এখন ‘মন-শরীর সংযোগ’ (Mind-Body Connection) তত্ত্বের মাধ্যমে এই রহস্যের উন্মোচন করছেন।
মনোবিদ এবং ‘সাইকোলজি টুডে’ পত্রিকার কলাম লেখক সুজান ব্যাবেল সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, শরীরের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ অনুভূত হওয়া এই ব্যথাগুলো আসলে আবেগপ্রবণ উৎসের ফলাফল। আমাদের চাপা পড়া অনুভূতি, অপ্রকাশিত আবেগ বা মানসিক চাপই শারীরিক যন্ত্রণার রূপে প্রকাশিত হতে পারে। এই তত্ত্ব শরীর এবং মনের গভীর সম্পর্ককে নতুন করে বুঝতে সাহায্য করছে।
সুজান ব্যাবেল শরীরের ১২টি নির্দিষ্ট অঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিটি অঙ্গে ব্যথার পেছনের আবেগ-ঘটিত কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। আসুন, দেখে নেওয়া যাক কোন অঙ্গে ব্যথা কী মানসিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয়:
- ১: মাথা (মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন): অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস এর প্রধান কারণ। যখন মন অতিরিক্ত চিন্তায় ভারাক্রান্ত থাকে, তখন মাথা ব্যথার আকারে তা প্রকাশ পেতে পারে।
- ২: ঘাড়: এই এলাকায় নিয়মিত ব্যথার অর্থ হলো কোনো কিছুকে ক্ষমা করতে না পারা। অতীত বা বর্তমানের কোনো রাগ বা ক্ষোভ ঘাড়ে ব্যথা হিসেবে অনুভূত হতে পারে।
- ৩: কাঁধ: অতিরিক্ত মানসিক ভার বা দায়িত্বের বোঝা কাঁধে ব্যথা তৈরি করতে পারে। যখন মনে হয় সব দায়িত্ব আপনার কাঁধে এসে পড়েছে, তখন এই অঞ্চলে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
- ৪: পিঠের উপর দিক: একাকীত্ববোধ বা নিজের আবেগ প্রকাশ করার মতো কোনো জায়গা না থাকলে এই ব্যথা দেখা যায়। নিজের অনুভূতিগুলো মনের মধ্যে চেপে রাখলে এটি পিঠের উপরের অংশে চাপ তৈরি করে।
- ৫: পিঠের নীচের দিক: আর্থিক দুশ্চিন্তা, ঋণ বা ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি পিঠের নিচের অংশে ব্যথা হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে।
- ৬: বাহু ও কনুই: যাদের চিন্তা অতিরিক্তমাত্রায় অপরিবর্তনীয় বা কঠোর, যারা সহজে কোনো কিছু মেনে নিতে পারেন না, তাদের এই অঙ্গে ব্যথা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
- ৭: হাতের তালু: সামাজিক মেলামেশা কমে আসা বা নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করার ফলে এখানে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। যখন আমরা মানুষের থেকে দূরে সরে আসি, তখন এই ব্যথা দেখা দেয়।
- ৮: নিতম্ব: কোনো বিশেষ সিদ্ধান্তকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাওয়া বা নমনীয় না হওয়ার প্রবণতা নিতম্বে ব্যথা তৈরি করতে পারে।
- ৯: হাঁটু: নিজেকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভাবা বা তুমুল অহমিকাবোধ হাঁটুর ব্যথার কারণ হতে পারে। যখন আমরা নিজেদেরকে অন্যের থেকে বড় মনে করি, তখন এই ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- ১০: কবজি: তীব্র ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতার মতো নেতিবাচক আবেগ কবজির ব্যথার উৎস হতে পারে।
- ১১: গোড়ালি: জীবনে একঘেয়েমি বা পরিবর্তনের অভাব যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন গোড়ালিতে ব্যথা হতে পারে।
- ১২: পায়ের পাতা: পায়ের পাতায় অসহ্য ব্যথা গভীর অবসাদের লক্ষণ হতে পারে। অবসাদ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এই ধরনের শারীরিক কষ্ট অনুভূত হতে পারে।
সুজান ব্যাবেলের এই তত্ত্ব আমাদের শরীরের প্রতি আরও মনযোগী হতে শেখাচ্ছে। শুধুমাত্র শারীরিক উপসর্গ দেখে ওষুধ খাওয়ার বদলে, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং আবেগের প্রতিও নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই ব্যথাগুলি হয়তো আমাদের শরীর ও মনের মধ্যেকার সংযোগের এক নীরব বার্তা, যা আমাদের ভেতরের অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোকে স্বীকৃতি দিতে শেখায়।