বেসরকারি হাসপাতালের বিল নিয়ন্ত্রণে নতুন বিল পাশ, বিজেপির সমস্ত আপত্তি খারিজ

দুই দিনের ম্যারাথন বিতর্ক ও টানটান উত্তেজনার পর অবশেষে পাশ হলো ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট (সংশোধনী) বিল, ২০২৪। বেসরকারি হাসপাতালগুলির লাগামহীন বিল আদায়ে রাশ টানতেই এই নতুন আইন আনলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার। যদিও বিলটি পাশ করাতে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে বিরোধী বিজেপি’র তীব্র আক্রমণের মুখে পড়তে হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী বিধায়কদের প্রস্তাবিত কোনো সংশোধনীই ধোপে টিকলো না।

এদিন বিধানসভায় বিলের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগীদের থেকে অতিরিক্ত বিল আদায়ের অসংখ্য অভিযোগ আসছে। এই বিলের মূল উদ্দেশ্য হলো সেই প্রবণতা বন্ধ করা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা।” তিনি স্পষ্ট করে জানান, নতুন আইনে রোগীকে ভর্তির সময় যে প্যাকেজের কথা বলা হবে, তার চেয়ে বেশি বিল হলে তার সুনির্দিষ্ট কারণ রোগীর পরিবারকে জানাতে হবে। প্রতিটি খরচের বিস্তারিত ব্রেক-আপ দিতে হবে। “পাঁচটা ইনজেকশন দিয়ে কুড়িটার দাম নেওয়া, এটা চলবে না,” দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি আরও যোগ করেন, বিলটিতে মোট ১৬টি সংশোধনী আনা হয়েছে এবং বেসরকারি হাসপাতালে মহিলা রোগী ও কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এক্ষেত্রে শুধু নির্দেশিকা জারি করতে পারে, সরাসরি হস্তক্ষেপ নয়।

তবে সরকারের এই পদক্ষেপকে ‘ভুল’ আখ্যা দিয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বিলের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আরজি করের সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মহিলা চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে এই সংশোধনীতে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই, যা অত্যন্ত জরুরি।”

প্যাকেজ সিস্টেমের ভালো দিকটি মানলেও শুভেন্দু অধিকারীর উদ্বেগ ছিলো সেই ২ থেকে ৫ শতাংশ রোগীকে নিয়ে, যারা এই প্যাকেজের খরচ মেটাতে পারবে না। “তাদের দায়ভার কে নেবে?” প্রশ্ন তোলেন তিনি। পাশাপাশি, প্রতিটি প্যাকেজের বিস্তারিত বিবরণ সরকারি পোর্টালে প্রকাশ করার দাবি জানান যাতে রোগীরা কোনোভাবেই প্রতারিত না হন।

বিরোধী দলনেতা অভিযোগ করেন, “এই বিলটি তড়িঘড়ি পাশ করানো হচ্ছে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আরও সময় নিয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানো দরকার ছিল।” তিনি ই-প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে রোগীর গোপনীয়তা ভঙ্গের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন।

রাজনৈতিক আক্রমণ শানিয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “এই আইন পাশ হলে তৃণমূল হাসপাতালগুলো থেকে আরও বেশি টাকা তুলবে এবং নিজেদের লোকেদের হাসপাতালে স্টাফ হিসেবে ঢোকাবে।” তিনি এও অভিযোগ করেন যে, বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ‘লাটে’ তোলার চেষ্টা করছে এবং এই বিলের কারণে বহু রোগী চিকিৎসার জন্য রাজ্যের বাইরে চলে যাবেন।

নির্মল মাজির পাল্টা জবাব: “নেতাদের মদতে নার্সিংহোমের রমরমা”
শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগের জবাব দেন তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজি। তিনি বলেন, “কিছু রাজনৈতিক নেতার মদতে নানা জায়গায় নার্সিংহোম গজিয়ে উঠছে, যেখানে অকারণে সিটি স্ক্যান, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি এবং অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এমনকি, মৃতদেহকেও ভেন্টিলেটরে রেখে দেওয়া হয় শুধু বিল বাড়ানোর জন্য।” তার এই অভিযোগ বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অন্ধকার দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে।

বিল পাশ ও আগামী পদক্ষেপ
বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ বিলটিতে আরও সংশোধনী আনার প্রস্তাব করলেও, তাঁর সবকটি প্রস্তাবই খারিজ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দু’দিনের বিতর্কের পর বিধানসভায় ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট সংশোধনী বিল পাশ হয়। এখন বিলটি অনুমোদনের জন্য রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে পাঠানো হবে। রাজ্যপাল অনুমোদন দিলেই নতুন এই সংশোধনীগুলি আইনগতভাবে কার্যকর হবে।

পূর্ব ভারতের বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠনের সভাপতি রূপক বড়ুয়া বিলের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালের বিলের উপর জোর দেওয়া ভালো উদ্যোগ। প্যাকেজের কথা একদিক দিয়ে ভালো, কিন্তু চিকিৎসার সময় অনেক ক্ষেত্রে তা সবসময় সম্ভব হয় না। তাই প্যাকেজের বাইরে বিল হলে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে দেখতে হবে।”

পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই নতুন আইন কতটা পরিবর্তন আনতে পারে এবং সাধারণ মানুষ এর সুফল কতটা পায়, এখন সেটাই দেখার।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy