বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিশানা করে চালানো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইরানে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের নিহত হওয়ার ঘটনা আবারও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সক্ষমতাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের তৎপরতার গল্প এতটাই নিখুঁত যে অনেকে একে গোয়েন্দা উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু কীভাবে ইসরায়েল তার শত্রুদের বিরুদ্ধে এত নিখুঁত ও সফল অভিযান পরিচালনা করে? তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সক্ষমতা এবং কার্যপদ্ধতি নিয়েই আজকের বিশেষ প্রতিবেদন।
ইতিহাসের পাতায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সাফল্যের নিদর্শন
সাম্প্রতিক হামলা নতুন না হলেও, এর তীব্রতা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত বছর ২৭শে সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানপন্থি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। একই হামলায় দাহিয়াহ এলাকায় হিজবুল্লাহর অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কমান্ডাররাও প্রাণ হারান।
হিজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও ইসরায়েলি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু করার নজির রয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত পেজার ও ওয়াকি-টকির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় ৩৭ জনকে হত্যা করে। ২০২৪ সালে এক সপ্তাহের ব্যবধানে হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ইসরায়েলের গুপ্ত হামলায় নিহত হন, যা তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।
এর আগেও, ২০০৬ সালে দুই প্রতিপক্ষ এক অমীমাংসিত যুদ্ধে জড়িয়েছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিক ভবনকেও লক্ষ্যবস্তু করে ইসরায়েল, যেখানে ইরানি বিপ্লবী গার্ড ও অন্যান্য কর্মীসহ মোট ১৩ জন নিহত হন। একই বছরের জুলাইয়ে আরেক হামলায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ তেহরানে নিহত হন। ইসরায়েল এই হত্যার দায় স্বীকার না করলেও, এর পেছনে ইসরায়েলেরই জড়িত থাকার ধারণা প্রবল।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ
ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যবস্থার ইতিহাস দেশটির অস্তিত্বের চেয়েও পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনামলে (১৯২২-১৯৪৮) ‘শাই’ নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ইহুদি আধা-সামরিক সংগঠন ‘হাগানাহ’র গোয়েন্দা শাখা হিসেবে কাজ করত। ইসরায়েল সৃষ্টির পর সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বর্তমান গোয়েন্দা কাঠামো, যা মূলত তিনটি প্রধান ইউনিট নিয়ে গঠিত:
মোসাদ (Mossad): ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে মোসাদের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রধান কাজ হলো ইসরায়েলকে বাইরের হুমকি থেকে রক্ষা করা এবং দেশটির অস্তিত্ব নিরাপদ রাখা। বিশ্বজুড়ে এর অভিযানগুলো প্রায়শই গোয়েন্দা উপন্যাসের কাহিনীকেও হার মানায়।
শাবাক বা শিন বেট (Shin Bet/Shabak): এটি গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে এবং এর দায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিন বেট দাবি করে, তারা পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আসা হুমকির বিরুদ্ধে ‘অদৃশ্য ঢাল’ হিসেবে কাজ করে।
আমান (Aman): এটি ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাধারণ সদর দপ্তরের অধীনে কাজ করে। এর মূল কাজ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সামরিক কমান্ডকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা। আমান কয়েকটি ইউনিট নিয়ে গঠিত হলেও এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হলো ৮২০০, ৯৯০০ এবং ৫০৪।
আমানের মূল ইউনিটগুলোর সক্ষমতা
• ইউনিট ৮২০০: ‘ইলেকট্রনিক কানে’ ইসরায়েলের চোখ-কান
ইউনিট ৮২০০-কে ইসরায়েলি গোয়েন্দা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয়। এই ইউনিটের মাধ্যমেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, এটি তাদের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট, যেখানে ১০ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেন। এই ইউনিটে যারা কাজ করেন, তারা এলিট ও শিক্ষিত বাহিনী থেকে বাছাই করা। মোসাদ ও শিন বেটের সদস্যদের চেয়েও এর কর্মী সংখ্যা বেশি।
ইউনিট ৮২০০-এর দায়িত্বগুলো বহুমুখী:
যোগাযোগ ব্যবস্থার ওয়্যারট্যাপিং (গোপনে আড়ি পাতা)।
গোয়েন্দা ও সামরিক তথ্য ডিকোড করা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা।
সাইবার হুমকির শনাক্তকরণ।
গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য ইলেকট্রনিক ও সাইবার ডিভাইস তৈরি করা।
প্রযুক্তির দিক থেকে ইউনিট ৮২০০-কে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সমতুল্য মনে করা হয়। তাদের কার্যক্রম সবসময় গোপন রাখা হলেও, সামরিক ও গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ইসরায়েলকে রক্ষা কিংবা ইসরায়েলের হয়ে আক্রমণ উভয় ধরনের অভিযানে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১০ সালে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর স্টাক্সনেট (Stuxnet) ভাইরাসের মাধ্যমে সাইবার হামলায় এই ইউনিটের জড়িত থাকার ব্যাপক ধারণা রয়েছে।
• ইউনিট ৯৯০০: ইসরায়েলের ‘আকাশ থেকে চোখ’
যদি ইউনিট ৮২০০-কে ইসরায়েলের ‘কান’ বলা হয়, তাহলে ইউনিট ৯৯০০-কে তার ‘চোখ’ বলা যেতে পারে। এই ইউনিটের দায়িত্ব হলো স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে সেনা কমান্ডার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট পৌঁছে দেওয়াও এই ইউনিটের দায়িত্ব। ২০২০ সালে এই ইউনিটের ভেতরে আরেকটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার দায়িত্ব হলো গোয়েন্দা ড্রোনের কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করা। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইরানকে পর্যবেক্ষণ করাও ইউনিট ৯৯০০-এর দায়িত্ব, যা ইসরায়েলের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ‘হরাইজন ১৩’ দিয়ে করা হয়।
• ইউনিট ৫০৪: ‘মানব গোয়েন্দা’র অদৃশ্য হাত
ইউনিট ৫০৪ গঠিত হয়েছে মানুষের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য। এই ইউনিটের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের ভেতরের সব হুমকি নজরে রাখা। তবে এর পাশাপাশি এই ইউনিট ইসরায়েলের সীমান্তের বাইরেও গুপ্তচর নিয়োগ করে। গাজাসহ অন্যান্য দেশেও এর সদস্যরা সক্রিয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, দেশের নিরাপত্তায় এই ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এটি শত শত সফল অপারেশন চালিয়েছে। এর কার্যকলাপ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। ইউনিট ৫০৪ সাধারণ মানুষের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনে মোসাদ ও শিন বেটের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে।
‘ব্রাঞ্চ ৫৪’: ইরানের বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট?
২০২৩ সালের জুন মাসে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর আসে যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে নতুন এক গোয়েন্দা ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার নাম ‘ব্রাঞ্চ ৫৪’। এর মূল কাজ হলো ইরান এবং ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। ‘ওয়াই নেট’ নামের ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রথম এই খবর প্রকাশিত হয়। তখন এই ইউনিটে মাত্র ৩০ জন সদস্য কাজ করতেন।
এই ইউনিটের এক কমান্ডার (যাঁর নাম প্রকাশ করা হয়নি) বলেছেন, “ব্রাঞ্চ ৫৪ প্রতিষ্ঠা এই ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানি সামরিক হুমকি সম্পর্কে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।” তিনি বলেন, “ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ, হিজবুল্লাহ, হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে যুদ্ধের মতো একেবারেই হবে না।”
ব্রাঞ্চ ৫৪-এর দায়িত্ব হচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে ইরানের নিরাপত্তা কাঠামো এবং সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা। এই গোয়েন্দা ইউনিটের একটি অংশ ইরানের সেই স্থানগুলো শনাক্ত করে, যেখানে যুদ্ধ শুরু হলে আক্রমণ চালানো যাবে। কমান্ডার বলেন, “আমরা প্রতিদিন টার্গেট শনাক্ত এবং গবেষণা করি। কীভাবে সেগুলোতে প্রভাব ফেলা যায়, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। আমরা ইতোমধ্যে ইরানের অনেক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করেছি এবং তাদের পরমাণু শক্তি থাকলেও তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ইরানে সাম্প্রতিক হামলায় ইসরায়েলের এই নতুন গোয়েন্দা ইউনিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইসরায়েলের এই বহুস্তরীয় এবং অত্যন্ত সক্ষম গোয়েন্দা নেটওয়ার্কই তাদের ‘অদৃশ্য ঢাল’ হিসেবে কাজ করে, যা তাদের প্রতিপক্ষের জন্য এক নিরন্তর চ্যালেঞ্জ।
সূত্র: বিবিসি।