বিহারের রাজনীতিতে একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো: বিহারীরা ভোট কাস্ট (Vote) করে না, কাস্টকে (Cast/জাতি) ভোট দেয়। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই জাতপাতের সমীকরণ কতটা জটিল এবং রক্তক্ষয়ী ছিল, তা আবারও আলোচনার কেন্দ্রে। একসময় জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই পদবি ত্যাগ করলেও, বিহারের সমাজ আজও জাতপাতের সংঘাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
❌ ‘ভূরাবালকো খতম করো’—লালুপ্রসাদের সেই বিতর্কিত ডাক
১৯৯০-এর দশকে বিহারের রাজনীতি তখন টগবগ করে ফুটছে। এক রক্তারক্তি পরিস্থিতিতে পাটনার অদূরে বক্সারের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব উঁচুজাতের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধের ডাক দেন।
রাজধানী পাটনার কাছেই দরিয়াপুর ও তিস্কহোরা গ্রামে উচ্চবর্ণের গুণ্ডাদের হামলায় নিম্নবর্ণের যথাক্রমে পাঁচ ও পঁচিশজন মানুষ খুন হওয়ার পর লালুপ্রসাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। উচ্চবর্ণের মানুষের খাস তালুকে জনসভার বিশাল জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি গর্জে ওঠেন:
“ভূরাবালকো খতম করো।”
এই মন্তব্যের পর রাজ্যজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়।
জাতিগত সংঘাতের নেপথ্যে ‘ভূরাবাল’ কারা?
লালুপ্রসাদের তৈরি ‘ভূরাবাল’ শব্দটি ছিল পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। এটি বিহারের প্রধান চার উঁচু জাতের আদ্যক্ষর দিয়ে তৈরি:
ভূ — ভূমিহার
রা — রাজপুত
বা — ব্রাহ্মণ
ল — কায়স্থ (লালা)
এই চারটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ২০২৩ সালের জাত গণনা অনুযায়ী কমে এখন দশ শতাংশের নীচে নেমে এলেও, একসময় জমি-জায়গা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার প্রায় ৯০-৯৫ শতাংশই এই ১৫ শতাংশ (পূর্বের হিসাব অনুযায়ী) মানুষের দখলে ছিল।
⚔️ জমি দখল ও জাতিগত সেনাবাহিনী
বিহারের মধ্য বিহারে গঙ্গা ও শোন নদীর অববাহিকায় উর্বর মাটির কারণে জমির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এর দখল নিয়েই উঁচু ও নিচু জাতের লড়াই রীতিমতো যুদ্ধে পরিণত হয়।
উচ্চবর্ণের সেনা: ভূমিহাররা তৈরি করেছিল রণবীর সেনা, ব্রাহ্মণ, রাজপুতরা তৈরি করেছিল কুয়ের সেনা, ব্রহ্মর্ষি সেনা, সূর্যালোক সেনা এবং সোয়ার্ন লিবারেশন আর্মি।
নিম্নবর্গের সেনা: অন্যদিকে কুর্মি, যাদবদের মতো মধ্যবর্গীয় সম্প্রদায়গুলির হয়ে লড়াই করত ভূমি সেনা এবং লরিক সেনারা।
প্রকাশ লুই-এর বই অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০০০—এই ২৪ বছরের মধ্যে শুধু মধ্য বিহারেই ৯৪টি জাতিগত গণহত্যা হয়েছিল, যার শিকার বেশিরভাগই নিম্নবর্গের মানুষ। লালুপ্রসাদের জমানায় ভোজপুরের বথানিটোলা ও জাহানাবাদের লক্ষ্মণপুর বাথেতে উচ্চবর্ণের ভাড়াটে সেনাদের হামলায় যথাক্রমে ২২ জন ও ৫৮ জন দলিত ও মুসলিমকে হত্যা করা হয়।
লালুপ্রসাদের ‘ভূরাবাল খতম’-এর ডাক রক্তক্ষয়ী না হলেও, এটি রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পরই যাদব লালুপ্রসাদ ও রাবড়িদেবীর পর মধ্যবর্গীয় সম্প্রদায়ের নেতা নীতীশ কুমার কম-বেশি কুড়ি বছর বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে আসীন হন।