উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব, বায়োচার প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার দিশা

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ফোক আর্টস অ্যান্ড মিউজিক’ (COFAM) বিভাগ উত্তরবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পরিবেশবান্ধব ‘বায়োচার’ প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা শুধু মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিই নয়, কৃষকদের স্বনির্ভরতার পথও দেখাচ্ছে। এই উদ্ভাবন বিশেষভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের, বিশেষত উত্তরবঙ্গের চা চাষিদের মাটির গুণমান উন্নয়নে সহায়তা করবে।

COFAM বিভাগ এমন একটি সহজলভ্য ও স্থানীয় উপকরণ-ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যার মাধ্যমে কৃষকরা নিজেরাই অতি সহজে বায়োচার তৈরি করতে পারবেন। এটি কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের এক বড় ধাপ।

বায়োচার কী ও এর উপকারিতা?
বায়োচার হলো মূলত কাঠকয়লার মতো দেখতে একধরনের জৈব পদার্থ, যা অক্সিজেন-সীমাবদ্ধ পরিবেশে জৈববস্তুর (যেমন ফসলের অবশেষ) ‘পাইরোলাইসিস’ (তাপ-বিঘটন) প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। এতে উচ্চমাত্রায় কার্বন ও ছাই থাকে এবং এটি মাটিতে প্রয়োগ করলে অসংখ্য উপকার হয়। এর মধ্যে রয়েছে:

মাটির বায়ুচলাচল বৃদ্ধি: বায়োচার মাটির কণার মধ্যে ফাঁকা স্থান তৈরি করে, যা বায়ুচলাচল উন্নত করে।

অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কমানো: এটি মাটির pH ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, বিশেষ করে অম্লীয় মাটির ক্ষেত্রে।

পুষ্টির লিচিং কমানো: বায়োচার পুষ্টি উপাদানগুলিকে মাটিতে ধরে রাখে, যা জল দ্বারা ধুয়ে যাওয়া (লিচিং) কমায়।

জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি: এটি মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে খরা মোকাবিলায় সহায়তা করে।

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বায়োচার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই বায়োচারকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারণ এটি হাজার হাজার বছর ধরে মাটিতে অবিকৃত অবস্থায় থাকতে পারে, ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণের একটি টেকসই উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি ‘কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন’-এর একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি।

COFAM বিভাগের মতে, এই প্রযুক্তিতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বড় কোম্পানি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। তবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো, কৃষকরা যাতে কোনো কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন এবং নিজেদের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারেন।

বিশেষজ্ঞের সতর্কতা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বায়োচার প্রয়োগের সময় সঠিক পরিমাণ ও উপযুক্ত কাঁচামাল (ফিডস্টক) ব্যবহার না হলে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মাটির জৈব গুণাগুণ হ্রাস, pH ভারসাম্য পরিবর্তন অথবা লবণাক্ততা বৃদ্ধি। তাই কৃষকদের প্রশিক্ষিত হয়ে এটি ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।

তবুও, বর্তমান জলবায়ু সংকটের সময়ে দাঁড়িয়ে COFAM বিভাগের এই উদ্যোগ উত্তরবঙ্গের কৃষিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। কৃষি গবেষক ও পরিবেশবিদরা আশা করছেন, এই বায়োচার প্রযুক্তি কেবল মাটির স্বাস্থ্যই ফেরাবে না, বরং কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী করে তুলতেও বড় ভূমিকা পালন করবে। এটি অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy