পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এক ঐতিহাসিক মোড় এল। রাজ্যের শ্রম দফতর গত ১৩ জুন, শুক্রবার একটি নতুন এবং আপডেট করা ‘মডেল ১০০-পয়েন্ট রোস্টার’ প্রকাশ করেছে। এই বিজ্ঞপ্তিটি রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সরকারি চাকরিপ্রার্থীর জন্য এক দারুণ খবর, কারণ এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলিতে গতি আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে জটিলতা কেটে যাওয়ার পরপরই এই রোস্টার জারি হওয়াকে প্রশাসনিক মহল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে।
স্বচ্ছতার নতুন কাঠামো: কী আছে এই রস্টার-এ?
মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের স্বাক্ষরিত এই নতুন রোস্টারটি রাজ্যের সমস্ত সরকারি দফতর এবং প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদগুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট করবে। ইতিমধ্যেই রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে এই বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদপত্র ‘বর্তমান’ দাবি করেছে।
এই রোস্টার তপশিলি জাতি (SC), তপশিলি উপজাতি (ST), অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC), আর্থিকভাবে দুর্বল বিভাগ (EWS), প্রতিবন্ধী ব্যক্তি (PwD) এবং প্রাক্তন সমরকর্মীদের জন্য সংরক্ষণের নিয়মগুলিকে একটি সুসংহত ও স্বচ্ছ কাঠামোর অধীনে এনেছে। এর ফলে, ভবিষ্যতে সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেন এই নতুন রোস্টার?
২০১১ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন শ্রম দফতরের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সই করা একশো পয়েন্ট রোস্টারের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল, যা ওবিসি ‘এ’ এবং ‘বি’ শ্রেণিদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। পরবর্তীকালে, EWS সংরক্ষণের জন্য শ্রম দফতরকে আবার রোস্টার তৈরি করতে হয়েছিল। সম্প্রতি ওবিসি সংরক্ষণে জটিলতা তৈরি হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী নতুন সমীক্ষার ভিত্তিতে জাতিগুলিকে ‘এ’ এবং ‘বি’ শ্রেণিতে নির্দিষ্টকরণসহ নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। এই কারণেই ফের নতুন করে একশো পয়েন্ট রোস্টার তৈরি করার প্রয়োজন পড়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার বলেছেন যে, ওবিসি সংরক্ষণের জটিলতা কেটে গেলেই রাজ্য সরকার লক্ষাধিক পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করবে। সরকারি অফিসে শূন্যপদে নিয়োগের জন্য পিএসসি আছেই, পাশাপাশি নতুন করে গঠন করা হয়েছে স্টাফ সিলেকশন কমিশন (এসএসসি)। সরকারি অফিসে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্যই এই উদ্যোগ। সল্টলেক-নিউটাউনে এসএসসির নতুন অফিস ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০-পয়েন্ট রোস্টারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, কারণ এই রোস্টারে একশোটি পদের কোনটি কাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে তা নির্দিষ্ট করা থাকে। একশোর বেশি শূন্যপদ হলেও এই মডেল অনুসরণ করে সংরক্ষণ করা হয়।
১০০-পয়েন্ট রোস্টার কী এবং কীভাবে কাজ করে?
১০০-পয়েন্ট রোস্টার হলো একটি তালিকা যা নির্ধারণ করে পর পর ১০০টি শূন্যপদের মধ্যে কোনটি কোন সংরক্ষিত বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকবে। যখনই কোনো সরকারি দফতরে নিয়োগ হয়, এই তালিকা অনুসরণ করে বিভিন্ন বিভাগের প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে সাংবিধানিক সংরক্ষণের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা হয়।
সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি (SC), তফসিলি জনজাতি (ST), ওবিসি (এ এবং বি শ্রেণি), অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি (EWS) ছাড়াও বিশেষভাবে সক্ষম (PwD), এগজেমটেড ক্যাটেগরি (EC) এবং প্রাক্তন সেনাকর্মীদের জন্য পদ সংরক্ষিত রাখতে হয়। সংরক্ষিত পদের মধ্যেও আবার উপ-সংরক্ষণ থাকে। যেমন, SC-দের জন্য সংরক্ষিত কোনও কোনও পদ আবার এগজেমটেড ক্যাটেগরি বা প্রাক্তন সেনাকর্মীদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। কোন পদটি কাদের জন্য সংরক্ষিত বা সংরক্ষিত নয়, তা পদের ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী রোস্টারে নির্দিষ্ট করা থাকে। পিএসসি বা অন্য কোনও সরকারি সংস্থা বা দফতর কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করার সময় এই রোস্টার অনুযায়ী কতগুলি পদ সংরক্ষিত বা সংরক্ষিত নয়, তা নির্দিষ্ট করে দেয়। সব মিলিয়ে, একশো পয়েন্ট রোস্টার ছাড়া সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
ক্যাটেগরি অনুযায়ী সংরক্ষণের শতাংশের তালিকা:
ক্যাটেগরি মোট শূন্যপদ (১০০ টির মধ্যে) সংরক্ষণের শতাংশ
অসংরক্ষিত (Unreserved) ৪৫ ৪৫%
তপশিলি জাতি (SC) ২২ ২২%
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি – এ (OBC-A) ১০ ১০%
আর্থিকভাবে দুর্বল বিভাগ (EWS) ১০ ১০%
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি – বি (OBC-B) ৭ ৭%
তপশিলি উপজাতি (ST) ৬ ৬%
Export to Sheets
এই নতুন রোস্টারটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা নিয়ে আসবে এবং লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর জন্য দ্রুত নিয়োগের পথ প্রশস্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবার দেখার বিষয়, এই নতুন কাঠামো কতটা দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। রাজ্যের যুব সমাজের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ পূরণের দিকে এটি কি এক নতুন সূচনা?
