লিভার সিরোসিস কেন হয়? এর লক্ষ্মণগুলো কী?

লিভার সিরোসিস একটি মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য রোগ। লিভারের নানারকম রোগের মধ্যে এটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ের একটি রোগ বলে গণ্য করা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে যকৃতের ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন ছাড়া পুরোপুরি আরোগ্য হয় না।

এই কারণে রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

দেশে এই রোগে কত আক্রান্ত হয়েছে বলে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, দেশের হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটির বেশি মানুষ। এদের পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ রোগী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। সেই হিসাবে দেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।

লিভার সিরোসিস কী?
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যখন লিভারের রোগের নানা পর্যায়ের পর কোষগুলো এমনভাবে আক্রান্ত হয় যে, লিভার আর কাজ করতে পারে না, সেই পর্যায়কে লিভার সিরোসিস বলে বর্ণনা করা হয়।

যখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, তখন লিভার বা যকৃৎ তার স্বাভাবিক কাজগুলো, যেমন বিপাক ক্রিয়া, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি, ওষুধ ও রাসায়নিকের শোষণ, খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি করতে পারে না।

লিভার সিরোসিস হলে লিভার বা যকৃতে সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিসের বিস্তার ঘটে। যকৃতে তখন ছোট ছোট দানা বাঁধে। আস্তে আস্তে সেটির বিস্তার ঘটতে থাকে। ফাইব্রোসিস ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আর লিভার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে না, ফলে লিভার সংকুচিত হয়ে পড়ে।

লিভার সিরোসিস কেন হয়?
ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন দেশের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, বি, সি এবং ডি ভাইরাসের আক্রমণে লিভারে প্রদাহের তৈরি হয়। লিভারে প্রদাহের তৈরি করে বলেই একে বলা হয় হেপাটাইটিস, যার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে বি ও সি ভাইরাসের আক্রমণে লিভার বা যকৃতের কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যায়, কার্যক্রম আস্তে আস্তে ব্যাহত হয়। এরপর একেই লিভার সিরোসিস বলা হয়ে থাকে।

এছাড়া আরও কয়েকটি কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে বলে তিনি জানান।

এরকম একটি বড় কারণ ফ্যাটি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে লিভারে যদি মাত্রাতিরিক্ত চর্বি জমে, তাহলে লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এক সময় এর ফলেও লিভার সিরোসিস হতে পারে।

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলছেন, ”শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ফ্যাটি লিভার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী ১৫ বছর পর লিভার সিরোসিসের বড় কারণ হবে ফ্যাটি লিভার। আর এদের অন্তত ২০ শতাংশ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে।”

দেশের বাসিন্দাদের অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত বলে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ শতাংশের নন-অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস জটিলতা রয়েছে।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, স্থূলতা, খাদ্যাভ্যাস, রক্তে কোলোরেস্টল ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে।

অতিরিক্ত মদ্যপান, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ইচ্ছেমত ওষুধ খাওয়া, রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া দূষিত পানীয়, ব্যবহার করা বরফ, খোলা শরবত বা ফলের মাধ্যমে যকৃতের রোগ ছড়াতে পারে।লিভার সিরোসিস আর লিভারের ক্যান্সার এক রোগ নয়। তবে লিভার সিরোসিস থেকে লিভারের ক্যান্সার হতে পারে।

লিভার সিরোসিসের লক্ষ্মণগুলো কী?
চিকিৎসকরা বলছেন, লিভার সিরোসিসের শুরুর দিকে তেমন উপসর্গ থাকে না। অনেক সময় পেটের আলট্রাসাউন্ড কিংবা পেটে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এই রোগটি ধরা পড়ে। জন্ডিসও যকৃতের রোগের একটি লক্ষণ। রক্ত পরীক্ষা, বায়োপসি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমেও রোগটি শনাক্ত হতে পারে।

ডা. মোহাম্মদ আলী বলছেন, তবে কিছু লক্ষণ দেখা গেলে যকৃতের রোগের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

যেমন শারীরিক দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পেটে অস্বস্তি, ওজন কমে যাওয়া. অবসাদ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে যাবে। লিভার সিরোসিস হলে পেটে বা পায়ে জল আসতে পারে, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হতে পারে। অনেকে চেতনা হারিয়ে কোমায়ও চলে যেতে পারেন।

লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা
চিকিৎসকরা যকৃতের রোগে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিকারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন। বর্তমানে বিশ্বে লিভার সিরোসিসের অনেক আধুনিক চিকিৎসা উদ্ভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-র ক্ষেত্রে শিশুদের জন্মের পরপরই টিকা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করাও এই টিকা নিতে পারেন।

হেপাটাইটিস সি- থেকে বাঁচতে এক রেজারে একাধিক ব্যক্তির শেভ না করা, রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা পরীক্ষা করে নেয়া, অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক পরিহার – ইত্যাদির মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

দুষিত জল, অতিরিক্ত মদ্যপান, খোলা ফলমূলের মতো যেসব কারণে যকৃতের রোগ হয়, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

ডা. মোহাম্মদ আলী বলছেন, ”অনেকগুলো কারণে লিভার সিরোসিস বা লিভারের রোগ হয়ে থাকে। সতর্ক হলে অনেকাংশে এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, শারীরিক পরিশ্রম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা, কোলোস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা, স্থূলতা দূর করা ইত্যাদির মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।”

তিনি জানান, দেশে এখন লিভার বা যকৃতের উন্নত মানের চিকিৎসা হচ্ছে। বড় শহরগুলোতে তো বটেই, জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও চিকিৎসা সহজলভ্য হয়েছে।

”লিভার সিরোসিস হলে সারা জীবন বহন করতে হয়, পুরোপুরি আরোগ্য লাভ হয় না। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জটিলতা দূর করা যেতে পারে।” বলছেন ড. আলী।

এই রোগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ চিকিৎসা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা যকৃত প্রতিস্থাপন। দেশেই এখন যকৃতের প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে। তবে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় দেশে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে।

Related Posts

© 2024 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy