প্লাটিলেট, ছোট কণিকায় লুকানো বড় বিপদ? কেন কমে, কী তার লক্ষণ, এবং ডেঙ্গুর সঙ্গে তার সম্পর্ক

মানবদেহের রক্তের তিন ধরনের কণিকার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকার হলো প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা। রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা অপরিহার্য; শরীরের কোথাও কেটে গেলে দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে প্লাটিলেটই সাহায্য করে। কিন্তু যখন এই গুরুত্বপূর্ণ রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যেতে শুরু করে, তখন তাকে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বলা হয়, যা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার জন্ম দিতে পারে। প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মূল কারণ দুটি— হয় প্লাটিলেট ধ্বংস হয়ে যায়, নয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না।

প্লাটিলেট কমে যাওয়ার কারণসমূহ:

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ দায়ী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  • অ্যানিমিয়া: রক্তে হিমোগ্লোবিন ও লোহিত রক্তকণিকা কমে যাওয়া।
  • ভাইরাস সংক্রমণ: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, হাম, মাম্পস, এইচআইভি ইত্যাদি।
  • লিউকেমিয়া: রক্তের ক্যানসার।
  • কেমোথেরাপি: ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
  • অতিরিক্ত মদ্যপান: লিভারের ক্ষতি করে প্লাটিলেট উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।
  • ভিটামিন-বি ১২ এর অভাব: প্লাটিলেট উৎপাদনে এই ভিটামিন গুরুত্বপূর্ণ।
  • তীব্র মাত্রার ক্যানসার বা পিত্তথলির মারাত্মক রোগ: কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসার বা গুরুতর পিত্তথলির রোগ প্লাটিলেট কমাতে পারে।
  • রক্তে ব্যাকটেরিয়াজনিত প্রদাহ: শরীরে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ।
  • ওষুধের প্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্লাটিলেট কমে যেতে পারে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাজনিত রোগ (Autoimmune diseases): শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন ভুল করে প্লাটিলেটকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়।

প্লাটিলেট কমে গেলে কী হয়? ঝুঁকির মাত্রা কত?

প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকার স্বাভাবিক মাত্রা হলো দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে। যদি কখনও এটি ২০ হাজারের নিচে নেমে যায়, তখন শরীরের ভেতরে (ইন্টারনাল) রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। প্লাটিলেট যদি ৫ হাজারের কম হয়, তখন ব্রেন, কিডনি, হার্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে রক্তক্ষরণের ভয় থাকে, যা জীবন বিপন্ন করতে পারে। তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেন যে মেশিনে প্লাটিলেট কাউন্ট নির্ভুল নাও হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট অনেক সময় দলা (clump) পাকিয়ে থাকে, ফলে মেশিন অনেকগুলোকে একসঙ্গে একটি ধরে সংখ্যা নিরুপণ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া মানেই সবসময় মেডিকেল ইমারজেন্সি নয়। অর্থাৎ, প্লাটিলেট কমে যাওয়া মাত্রই রোগী হঠাৎ রক্তক্ষরণে মারা যাবে, বিষয়টি এমনও নয়। প্লাটিলেট কমলে শরীরে এক ধরনের মাইনর ক্যাপিলারি ব্লিডিং দেখা যেতে পারে, যা ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হয়ে বেগুনি রঙের চিহ্ন বা পিনপয়েন্টের আকারে দেখা দেয়।

প্লাটিলেট কমে যাওয়ার লক্ষণসমূহ:

প্লাটিলেট কমে গেলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা যেতে পারে:

  • ত্বকে বেগুনি রঙের চিহ্ন (Petechiae বা Purpura) দেখা যাওয়া।
  • শরীরের যেকোনো স্থান থেকে সূক্ষ্ম রক্তপাত, যা পিনপয়েন্টের আকারে দেখা দেয়।
  • শরীরের কোথাও কাটলে অনেকক্ষণ ধরে রক্তপাত হওয়া।
  • মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হওয়া।
  • প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্তপাত।
  • মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া (নারীদের ক্ষেত্রে)।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা।

ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যাওয়া কি সবসময় বিপজ্জনক?

শুধু ডেঙ্গুর কারণেই যে প্লাটিলেট কমে তা কিন্তু নয়, অন্যান্য অনেক কারণেই এটি কমতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নামলেই রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গুর তীব্রতা মাপা হয় না। প্লাটিলেট ঠিক থাকলেই যে রোগী ভালো থাকবে, তা-ও নয়; আবার প্লাটিলেট দিলেই যে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে, এমনও নয়।

রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাধারণত নেওয়া হয় যখন:

  • রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা যায় এবং প্লাটিলেট কাউন্ট ২০ হাজারের নিচে নামে।
  • অথবা, রক্তক্ষরণ নেই কিন্তু প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাটিলেট কমে গিয়ে নয়, বরং রোগী মারা যায় মূলত ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’-এর কারণে। ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে রক্তনালিগুলো আক্রান্ত হয় এবং রক্তনালীর গায়ে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস বের হয়ে আসে, ফলে রক্তচাপ কমতে থাকে এবং পিসিভি (Packed Cell Volume) বা হেমাটোক্রিট বাড়তে থাকে। এটা ঠেকাতে তখন রোগীকে পর্যাপ্ত ফ্লুইড বা তরল দিতে হয়, যা মুখে খাওয়ানো বা শিরায় দেওয়া হয়ে থাকে।

তাই ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কত তা ঘন ঘন না দেখে বরং রোগীর অন্যান্য বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। যেমন— রক্তচাপ ঠিক আছে কি না, রোগী জলশূন্যতায় ভুগছে কি না, রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট কেমন তা দেখা উচিত। যদি এমনটি হয়, তাহলে পর্যাপ্ত তরল দিন বা ফ্লুইড কারেকশন করুন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy