পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলো কি কেবল নামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাকি ক্রমশ পরিণত হচ্ছে লাগামহীন বিনোদন ও রাজনৈতিক দাপটের আখড়ায়? সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও এই গুরুতর প্রশ্নটি আরও একবার সামনে এনেছে। ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের এক উৎসবে প্রাক্তন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা রানা বিশ্বাসের মাথায় মদের গ্লাস রেখে নৃত্য এবং সঙ্গে বেলি ড্যান্সারের উপস্থিতি, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাটি কি একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ, নাকি এটি রাজ্যের কলেজগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়ের এক বৃহত্তর চিত্রের প্রতিফলন?
ভাইরাল ভিডিওর নেপথ্যে কী?
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজের প্রাঙ্গণেই এক যুবক হিন্দি গানে কোমর দোলাচ্ছেন, তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে মদের গ্লাস। পাশে এক বেলি ড্যান্সারও উপস্থিত। এই যুবককে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন নেতা রানা বিশ্বাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রানা বিশ্বাস প্রায় এক দশক আগে কলেজ থেকে পাশ করে গেলেও, কলেজের উৎসবে তাঁর এমন ‘রাজকীয়’ উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাঁর মা কামারহাটি পুরসভার কাউন্সিলর হওয়ায় এই ঘটনার রাজনৈতিক যোগসূত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে।
প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনৈতিক চাপানউতোর
এই ঘটনা প্রসঙ্গে কলেজ প্রশাসন আশ্চর্যজনকভাবে নীরবতা পালন করেছে। গভর্নিং বডির সদস্য ও তৃণমূল নেতা গোপাল সাহার মন্তব্য, “আমি শুধু নাচ দেখেছি। বেলি ডান্স চিনি না। খারাপ কিছু মনে হয়নি,” বিতর্কের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গনে এমন কার্যকলাপকে ‘খারাপ কিছু মনে না হওয়া’ – এই মন্তব্য শিক্ষামহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বিরোধী দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সিপিএম নেতা সায়নদীপ মুখোপাধ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “এক সময় এই কলেজ ছিল সংস্কৃতির পীঠস্থান। এখন ছাত্রনেতা মাথায় মদের গ্লাস রেখে নাচেন!” রাজ্য কমিটির সদস্য গার্গী চট্টোপাধ্যায় আরও তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, “সব কলেজই এখন তৃণমূল নেতাদের ফুর্তির জায়গা।” বিজেপি নেতা অর্জুন সিং তোপ দেগে মন্তব্য করেছেন, “তৃণমূল কলেজগুলোকে বার বানিয়ে দিয়েছে।” এই অভিযোগগুলো কেবল একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে নয়, বরং রাজ্যের একাধিক কলেজে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সমষ্টিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট: কেবল রানা বিশ্বাস নয়
রানা বিশ্বাসের ভাইরাল ভিডিওটি সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটে যাওয়া একাধিক বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন। সম্প্রতি সাউথ কলকাতা ল কলেজে (কসবা ল কলেজ) ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রদের গোপনাঙ্গ দেখাতে বাধ্য করা, এবং মাথা টেপানোর মতো ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনা শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। বালিগঞ্জ আইটিআই কলেজে জন্মদিনের পার্টিতে মদ্যপান এবং তৃণমূল ছাত্রনেতার ‘দাদাগিরি’র অভিযোগও সংবাদ শিরোনামে এসেছিল।
এই ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি ধারাবাহিক প্রবণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে, এবং অভিযোগের তির সরাসরি শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের দিকে।
দলীয় অবস্থান এবং ভবিষ্যতের প্রশ্ন
রানা বিশ্বাসের ঘটনা নিয়ে প্রশাসন এবং তৃণমূল নেতৃত্ব এখনও মুখে কুলুপ এঁটেছে। প্রশ্ন উঠছে, একজন প্রাক্তন ছাত্র কীভাবে বছরের পর বছর ধরে কলেজের অনুষ্ঠানে এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেন এবং এমন বিতর্কিত আচরণ করতে পারেন, যখন শাসকদল এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না? রাজ্যের একাধিক কলেজে তৃণমূল ছাত্র নেতাদের একের পর এক এমন ‘দাদাগিরি’র ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় শাসকদলও বর্তমানে চাপের মুখে রয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনে এই ধরনের কার্যকলাপ কি কেবল একটি অনিয়ম, নাকি এটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সামগ্রিক অবহেলারই এক চিত্র? এই ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মান ও শিক্ষার পবিত্রতা রক্ষায় সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষ।