হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার বদলে ‘অতিরিক্ত বিল’-এর চাপে নাজেহাল হওয়া রোগীর পরিবারের ঘটনা আজ আর নতুন নয়। একটি সাধারণ চিকিৎসা বা অপারেশনের জন্য আগে থেকে জানানো প্যাকেজের বাইরে হাজার হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার এই অনিয়ন্ত্রিত দৌরাত্ম্যে লাগাম টানতে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করল রাজ্য সরকার। বিধানসভায় পেশ করা হয়েছে ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট (রেগুলেশন) সংশোধনী বিল, যা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ফেরাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।
নতুন বিলে আপনার অধিকার কী?
এই নতুন বিলটি আইনে পরিণত হলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগী ও তার পরিবারের অধিকার অনেকটাই সুরক্ষিত হবে:
-
প্যাকেজের বাইরে খরচ? লিখিত অনুমতি বাধ্যতামূলক: আপনার প্রিয়জনকে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করার সময় একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্যাকেজের কথা জানানো হবে। যদি সেই প্যাকেজের বাইরে কোনো অতিরিক্ত খরচ হয়, তবে হাসপাতালকে লিখিতভাবে আপনাকে জানাতে হবে এবং আপনার লিখিত সম্মতি নিতে হবে। মৌখিক আশ্বাস বা ইচ্ছামতো অতিরিক্ত বিল চাপানোর দিন শেষ।
-
বিস্তারিত হিসাব চাওয়ার অধিকার: প্যাকেজের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা চললে হাসপাতালকে একটি স্পষ্ট ও বিস্তারিত বিল দিতে হবে, যেখানে প্রতিটি খরচের পেছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও থাকবে। কী কারণে এবং কেন অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, তা জানার অধিকার আপনার থাকবে।
-
সব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আইনের আওতায়: এই সংশোধনী আইনে পরিণত হলে রাজ্যের সমস্ত নথিভুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার এই কঠোর নিয়মের আওতায় চলে আসবে। ফলে কোনো প্রতিষ্ঠানই এই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।
-
আইন অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা: রাজ্য সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এই আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেন এই বিল এত জরুরি ছিল?
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠছিল:
- অতিরিক্ত বিল চাপিয়ে দেওয়া: অনেক সময়ই হাসপাতালগুলি ছোটখাটো অপারেশন বা ডেঙ্গুর মতো নির্দিষ্ট রোগের জন্য একটি প্যাকেজ ঘোষণা করলেও, পরে নানা অজুহাতে বিল অনেকটাই বাড়িয়ে দিত, যা রোগীর পরিবারকে আর্থিক সংকটে ফেলত।
- ব্যাখ্যাহীন বাড়তি খরচ: রোগীর পরিবারের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, কীভাবে খরচ বাড়ল তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব বা কারণ হাসপাতাল থেকে জানানো হতো না।
- অপ্রয়োজনীয় আইসিইউ/ভেন্টিলেশন: রোগীর অবস্থা গুরুতর না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘক্ষণ আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে রাখার অভিযোগও বহুবার উঠেছে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল অতিরিক্ত বিল আদায়।
অবশ্য, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি হলো, রোগীর শারীরিক অবস্থার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে চিকিৎসা পদ্ধতিও বদলাতে পারে। নতুন কোনো সমস্যা ধরা পড়লে পরীক্ষা বা অতিরিক্ত ওষুধ দরকার হয়— এই কারণেই খরচ বাড়ে। তবে রাজ্য সরকারের অবস্থান এক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট: রোগীর পরিবারকে না জানিয়ে একতরফা খরচ চাপানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই সংশোধনী আইনে পরিণত হলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটাই বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চিকিৎসার নামে অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক চাপ বা শোষণের পথ অনেকটাই বন্ধ হবে, যা সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আসবে। এটি কেবল একটি বিল নয়, সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অধিকার সুরক্ষিত করার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।