কিসমিসের সাথে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। মিষ্টি খাবারে এর ব্যবহার যেমন বহুল প্রচলিত, তেমনই সরাসরি খেলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী। কিসমিস আসলে আঙুর ফলের শুকনো রূপ, আর সেই কারণেই একে শুকনো ফলের রাজাও বলা হয়ে থাকে। সোনালী-বাদামী রঙের চুপসানো ভাঁজ হওয়া এই ফলটি শক্তিদায়ক এক খাবার। সূর্যতাপ অথবা মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সাহায্যে আঙুরের ফ্রুক্টোজ জমাট বেঁধে তৈরি হয় এই মিষ্টি স্বাদের কিসমিস।
বিভিন্ন মিষ্টি খাবারের স্বাদ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে কিসমিসের ব্যবহার অপরিহার্য। পোলাও, কোরমা থেকে শুরু করে পায়েস, সেমাই—সবখানেই এর উপস্থিতি দেখা যায়। তবে রান্নার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও অনেকেই কিসমিসকে আলাদা করে খেতে দ্বিধা বোধ করেন, কেউ কেউ তো একে ক্ষতিকরও মনে করেন। অথচ পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম কিসমিসে রয়েছে ৩০৪ কিলোক্যালরি এনার্জি, ৭৪.৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১.১ গ্রাম ডায়েটরি ফাইবার, ০.৩ গ্রাম ফ্যাট, ১.৮ গ্রাম প্রোটিন, ৮৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭.৭ মিলিগ্রাম আয়রন, ৭৮ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম ও ২০.৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম। এটি রক্তে শর্করার মাত্রায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না, বরং এটি খেলে শরীরের রক্ত দ্রুত বৃদ্ধি পায়, পিত্ত ও বায়ুর সমস্যা দূর হয় এবং হৃদপিণ্ডের জন্যও এটি অত্যন্ত উপকারী।
আসুন, কিসমিসের কিছু উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:
দেহে শক্তি সরবরাহ করতে: দুর্বলতা দূরীকরণে কিসমিসের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এতে থাকা প্রাকৃতিক চিনি, গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ খুব দ্রুত শরীরে এনার্জি সরবরাহ করে। তাই দুর্বল লাগলে কিসমিস খাওয়া খুবই উপকারী।
দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষাতে: বাচ্চাদের ক্যান্ডি ও চকলেটের পরিবর্তে কিসমিস খাওয়ার অভ্যাস করালে দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা পায়। কিসমিসে থাকা ওলিনোলিক অ্যাসিড মুখের ভেতরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বাধা দেয়।
হাড়ের সুরক্ষাতে: কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে, যা হাড় মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এতে বোরন নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস থাকে, যা হাড়ের ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে এবং অস্টিওপরোসিসের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
ইনফেকশনের সম্ভাবনা দূরীকরণে: কিসমিসে পলিফেনলস এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিইনফ্লেমেটরী উপাদান থাকায় এটি কাঁটা-ছেঁড়া বা ক্ষত থেকে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধে: কিসমিসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের কোষগুলোকে ফ্রি র্যাডিক্যাল ড্যামেজের হাত থেকে রক্ষা করে এবং ক্যান্সারের কোষ উৎপন্ন হতে বাধা দেয়। এতে ক্যাটেচিন নামক পলিফেনলিক অ্যাসিডও রয়েছে, যা ক্যান্সারমুক্ত জীবন ধারণে সহায়ক।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে: প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার কারণে কিসমিস পরিপাকক্রিয়া দ্রুত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
রক্তশূন্যতা দূর করতে: কিসমিসে থাকা প্রচুর পরিমাণে লৌহ উপাদান রক্তশূন্যতা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যা অবসাদ ও দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে।
জ্বর নিরাময় করতে: কিসমিসের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে জ্বর নিরাময়ে সাহায্য করে।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে: কিসমিসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চোখের ফ্রি-রেডিক্যাল দূর করতে সক্ষম, যা বয়সজনিত দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ও ছানি পড়ার ঝুঁকি কমায়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে: কিসমিসের প্রধান উপাদান পটাশিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এন্টি কোলেস্টেরল উপাদানে: কিসমিসে কোনো কোলেস্টেরল না থাকার পাশাপাশি এতে এন্টি-কোলোস্ট্রোরেল উপাদানও রয়েছে, যা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
অনিদ্রা দূর করতে: কিসমিসে থাকা আয়রন অনিদ্রার চিকিৎসায় বিশেষভাবে উপকারী।
এসিডিটি কমাতে: কিসমিস রক্তের অতিরিক্ত এসিডিটি বা অম্লতা কমাতে সাহায্য করে, যা বাত, চর্মরোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
পরিপাক তন্ত্রের উপকারিতায়: নিয়মিত কিসমিস খেলে হজমশক্তি ভালো থাকে এবং এটি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল পথ থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে।
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষাকরনে: কিসমিসে থাকা অলিনিলীক অ্যাসিড মুখের ভেতরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বাধা দেয়।
ওজন বাড়াতে: যারা ওজন বাড়াতে চান, তাদের জন্য কিসমিস একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হতে পারে, কারণ এতে প্রচুর ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ থাকে।
মস্তিষ্কের জন্য উপকারি: কিসমিসে থাকা বোরন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক।
কিসমিস খাওয়ার নিয়ম:
১৫০ গ্রাম কিসমিস ভালো করে ধুয়ে এক গ্লাস জলে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে কিসমিস ছেঁকে নিয়ে সেই জল হালকা গরম করে খালি পেটে খান। এর পরে আধ ঘণ্টা আর অন্য কোনো খাবার খাবেন না। সপ্তাহে কমপক্ষে চার দিন এই জল খেলে এক মাসের মধ্যেই এর উপকারিতা অনুভব করতে পারবেন।
সুতরাং, আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় কিসমিস যোগ করুন এবং এই ছোট অথচ শক্তিশালী শুকনো ফলের অসাধারণ স্বাস্থ্যগুণ উপভোগ করুন।