লজ্জা নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর ও প্রয়োজনীয় আবেগ। এটি মানুষকে অনৈতিক ও ক্ষতিকর প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে এবং সমাজে শালীন আচরণ বজায় রাখতে সাহায্য করে। লজ্জার কারণেই আমরা অনেক লোভনীয় কিন্তু সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কাজ, যেমন চুরি বা পরকীয়া প্রেম থেকে নিজেদের সংযত রাখি।
তবে লজ্জা যখন স্বাভাবিকের অতিরিক্ত হয় বা এর বিকৃত প্রভাব দেখা যায়, তখন তা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। এই অতিরিক্ত লজ্জা ক্রমশ ক্রোধ, জেদ, অহংকার, বিষণ্নতা এমনকি নীরবতার মতো মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা এমন অবস্থাকে ‘সুপ্ত লজ্জা’ হিসেবে অভিহিত করেন।
সুপ্ত লজ্জায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবসময় লজ্জা ও অহংকারের এক অস্থির নাগরদোলায় দুলতে থাকেন। সামান্য সাফল্য তাদের সাময়িকভাবে গর্বিত করে তুললেও, ছোটখাটো ব্যর্থতাতেই তারা গভীর লজ্জা ও অক্ষমতার অনুভূতিতে ডুবে যান। এই সুপ্ত লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পেলে জীবন হয়ে উঠতে পারে আরও আনন্দময় ও স্বচ্ছন্দ। তাই সুপ্ত লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা নিম্নলিখিত ৫টি পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন:
১. লজ্জাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা:
প্রথমত, শনাক্তকরণের মাধ্যমে আপনার লজ্জাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসুন। সেই নির্দিষ্ট মানুষ, স্থান, বিষয় বা কার্যকলাপ চিহ্নিত করুন যা আপনি এড়িয়ে চলেন। এরপর এই এড়িয়ে চলার পেছনের সুপ্ত লজ্জার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। কারণ চিহ্নিত করতে পারলেই সমাধানের পথ খুলে যাবে।
২. পালিয়ে না বেড়ানো:
লজ্জার সহজাত প্রকৃতি হলো লুকিয়ে থাকা বা পালিয়ে বেড়ানো। তাই এর মোকাবিলা করতে হবে ঠিক বিপরীত পথে। যখন আপনি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলতে চাইবেন, তখন সরাসরি অন্যের চোখের দিকে তাকান এবং মনে মনে নিজেকে বলুন, ‘আমার এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।’ এই অভ্যাস ধীরে ধীরে আপনার ভেতরের ভয় ও লজ্জাকে জয় করতে সাহায্য করবে।
৩. যাদেরকে এড়িয়ে চলবেন:
যদি এমন কিছু মানুষ আপনার আশেপাশে থাকে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাকে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় বলে আপনি মনে করেন, তাহলে তাদের এড়িয়ে চলুন। তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ধরন পরিবর্তন করুন। নিজের মানসিক শান্তি ও আত্মসম্মান বজায় রাখা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
৪. পূর্বের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করা:
বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. গারশেন কাউফম্যান সুপ্ত লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি চমৎকার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। ছাত্রজীবনে একবার বক্তৃতা দেওয়ার সময় মঞ্চে পড়ে যাওয়ায় তিনি তীব্র লজ্জা অনুভব করেছিলেন এবং এরপর থেকে তার মধ্যে বক্তৃতাভীতি তৈরি হয়। পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি এই লজ্জা দূর করার জন্য বেশ কিছুদিন নির্জনে বসে সেই লজ্জাকর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করতেন এবং ইতিবাচক দৃশ্যের অবতারণা করে সেটিকে শেষ করতেন। এভাবে তিনি তার লজ্জাজনক স্মৃতিকে সাফল্যের স্মৃতিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক সময়ের দুঃস্বপ্ন বক্তৃতা ধীরে ধীরে তার কাছে আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয়। আপনিও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনার ভেতরের জমে থাকা লজ্জার স্মৃতিকে ইতিবাচক অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন করতে পারেন।
৫. ত্রুটিকে সহজে মেনে নিন:
লজ্জার সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস। নিজেকে সম্মান করতে শিখুন এবং নিজেকে একটি অনন্য সৃষ্টি হিসেবে ভাবতে শুরু করুন। মনে রাখবেন, কোনো মানুষই দোষত্রুটিমুক্ত নয়। আপনার মধ্যেও কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। সেই ত্রুটিগুলোকে সহজে মেনে নিন এবং নিজের ভেতরের গুণগুলোকে বিকশিত করার চেষ্টা করুন। আপনার বিকশিত গুণগুলোই তখন অন্যের কাছে সম্মানের পাত্র হবে এবং আপনার আত্মসম্মানবোধও বৃদ্ধি পাবে।
এই পাঁচটি পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি ধীরে ধীরে আপনার ভেতরের সুপ্ত লজ্জাকে জয় করতে এবং একটি আনন্দময় জীবন যাপন করতে সক্ষম হবেন। মনে রাখবেন, নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং আত্মসম্মানবোধই সকল নেতিবাচক আবেগ থেকে মুক্তির প্রধান চাবিকাঠি।