বিতর্ক-যুদ্ধে মানুষের চেয়েও এগিয়ে থাকবে এআই, নতুন গবেষকরা কী বলছেন?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তর্ক-বিতর্কে মানুষের চেয়েও বেশি দক্ষ হতে পারে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, যা প্রযুক্তি ও সমাজবিজ্ঞানী মহলে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এআই শুধু যে মানুষের মতোই ভালো তর্ক করতে পারে তাই নয়, বরং কখনও কখনও মানুষকে রাজি করানোর ক্ষেত্রেও এটি মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এই ফলাফলকে ‘উদ্বেগজনক’ আখ্যা দিয়েছেন, বিশেষ করে এর ফলে ভবিষ্যতের নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

গবেষণা বলছে, এআই চিৎকার করে কথা না বললেও, এটি যে তর্ক বা বিতর্ক করে না, এমনটা নয়। বরং তর্কে অন্যকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে এআই মানুষের মতোই ভালো কাজ করে, এবং কখনও কখনও মানুষের চেয়েও ভালো ফল দেখায়।

“উদ্বেগজনক” পরিস্থিতি
এই গবেষণার প্রধান লেখক ও সুইজারল্যান্ডের লোজানের ‘সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র গবেষক ফ্রানচেস্কো সালভি এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “যদি অসংখ্য বটকে এমনভাবে এআই ব্যবহার করে তৈরি করা যায়, যারা সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের টার্গেট করে তাদের জন্য আলাদা আলাদা রাজনৈতিক বার্তা পাঠাবে এবং যেগুলো আসল বলেই মনে হবে, তাহলে পরিস্থিতি কী হবে তা কল্পনা করুন।”

সালভি আরও সতর্ক করে বলেছেন, “এ ধরনের প্রভাব শনাক্ত করা কঠিন, নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভুল প্রমাণ করাও প্রায় অসম্ভব। আমি অবাক হব যদি এরইমধ্যে মানুষ খারাপ উদ্দেশ্যে এসব টুল ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ও অন্যায় প্রচারণা ছড়াতে না শুরু করে থাকে।”

তবে, সালভি মন গলাতে পারা এআইয়ের কিছু সুবিধার কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন – ষড়যন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস কমানো, রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে আনা এবং মানুষকে সুস্থ জীবনযাপনের জন্য উৎসাহিত করা।

গবেষণার পদ্ধতি ও ফলাফল
এই গবেষণাটি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার জার্নালে’ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় সালভি ও তার সহকর্মীরা তিনশ জন অংশগ্রহণকারীকে তিনশ জন মানব প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে এবং আরও তিনশ জন অংশগ্রহণকারীকে চ্যাটজিপিটি-৪ (একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম)-এর সঙ্গে মুখোমুখি করেছেন।

প্রতিটি জুটিকে একটি করে বিতর্কের বিষয় দেওয়া হয়েছিল। এসব বিষয়ের মধ্যে কিছু ছিল সহজ, যেমন – ‘শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত কি না’, আবার কিছু ছিল বেশি বিতর্কিত, যেমন – ‘গর্ভপাত কি বৈধ হওয়া উচিত?’ প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে যেকোনো একটি পক্ষের পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি দেওয়ার জন্য এলোমেলোভাবে বেছে নিয়েছিলেন গবেষকরা।

সব জুটির মধ্যে অর্ধেক ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীদের (মানুষ হোক বা মেশিন) কিছু অতিরিক্ত তথ্য দেওয়া হয়েছিল, যেমন – অন্য জনের বয়স, তারা ছেলে না মেয়ে, জাতিগত পরিচয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ।

ছয়শটি বিতর্কের ফলাফলে উঠে এসেছে যে, ব্যক্তিগত তথ্য না দেওয়া হলেও অন্যকে নিজের কথায় রাজি করানোর ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি-৪ মানুষের মতোই ভালো করেছে। গবেষকরা আরও বলছেন, এআইকে ব্যক্তিগত তথ্য দিলে এটি আরও বেশি সক্ষম হয়ে ওঠে, অথচ মানুষের বেলায় এমনটা হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে এআই আর মানুষ সমানভাবে কাজ করেনি, সেই সময়গুলোর মধ্যে ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রে এআই মানুষকে নিজের মত পাল্টাতে পেরেছে।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, এআই সবচেয়ে ভালোভাবে মানুষকে রাজি করাতে পেরেছে তখনই, যখন বিতর্কের বিষয়টি নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের খুব শক্ত বা দৃঢ় মতামত ছিল না।

মানুষের উপলব্ধি ও এআইয়ের কৌশল
গবেষকরা বলেছেন, মানুষদেরকে যখন এআইয়ের সঙ্গে জোড়া বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তখন প্রায় ৪ ভাগের ৩ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ঠিক বুঝে ফেলেছিল যে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একজন এআই। মানুষরা এআইয়ের যুক্তিগুলোকে মানুষের চেয়ে বেশি বিশ্লেষণভিত্তিক ও গুছানো বলে মনে করেছে। তবে মনে রাখতে হবে, সব অংশগ্রহণকারী তাদের নিজের মতামতের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলেন না; অনেক সময় এলোমেলোভাবেও মতামত দিয়েছেন।

গবেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এই কারণগুলোই এআইয়ের এতটা সক্ষম বা রাজি করাতে পারার পেছনের একমাত্র কারণ নয়। বরং এআইয়ের প্রভাব ফেলার মূল কারণ ছিল এর সক্ষমতা – প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তাদের মতামত অনুসারে যুক্তি বদলে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে এআইয়ের।

সালভি বলেছেন, “বিষয়টি হচ্ছে, আপনি যেন এমন কারো সঙ্গে তর্ক করছেন যিনি কেবল ভালো যুক্তিই দিচ্ছে না, বরং আপনার পছন্দমতো ভালো যুক্তি দিচ্ছে। কারণ সে জানে কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে হবে।” তিনি আরও বলেছেন, যদি আরও বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন কারো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যক্রম থেকে নেওয়া তথ্য পেত, তবে এআইয়ের এই প্রভাব ফেলার সক্ষমতা আরও বেশি হতে পারত।

এই গবেষণার ফলাফল কি সমাজে এআইয়ের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করবে? বিশেষ করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং জনমত গঠনে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আপনার কী ধারণা?

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy