“১৪৯ জনের পেনশন চালুর নির্দেশ”-হাইকোর্টের রায়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের মুখে হাসি

সারাজীবন সরকারি চাকরি করে অবসরের পর পেনশন না পাওয়ার ঘটনায় রাজ্য সরকার এবং বিভিন্ন পুরসভার তীব্র সমালোচনা করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। সম্প্রতি দু’টি পৃথক মামলায় বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মোট ১৪৯ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর পেনশন দ্রুত চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতির পর্যবেক্ষণে এই ঘটনাকে ‘প্রশাসনিক গাফিলতির চরম উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে রাজ্য ও তার বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগ একে অপরের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছে, আর তার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন যোগ্য কর্মীরা।

নবদ্বীপ পুরসভার ঘটনায় আদালতের পর্যবেক্ষণ
নবদ্বীপ পুরসভার একটি মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল অত্যন্ত কড়া। বিচারপতি কান্ত বলেছেন, প্রায় তিন দশক সরকারি চাকরি করার পর যদি কোনো কর্মী জানতে পারেন যে তাঁর চাকরিই স্থায়ী ছিল না এবং তিনি পেনশন-সহ অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী নন, তখন সরকারেরই তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে কর্মীদের প্রাপ্য পাওয়ার পথে কাঁটা না বিছিয়ে, সরকার ও বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের উচিত ছিল কর্মীদের প্রাপ্য পাওয়ার পথ প্রশস্ত করা। নবদ্বীপ পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর আট সপ্তাহের মধ্যে প্রাপ্য পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মেটানোর নির্দেশ দিয়ে বিচারপতি কান্ত আরও পর্যবেক্ষণ করেন যে, যে কর্মী তাঁর সারাজীবন সরকারি চাকরিতে দিয়েছেন, অবসরের পরে তাঁর পেনশন মেটানো সরকারের সাংবিধানিক দায় এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতা।

স্বপন দেবনাথের দৃষ্টান্তমূলক মামলা
নবদ্বীপ পুরসভার কর্মী স্বপন দেবনাথ ১৯৯০ সালে জঞ্জাল সাফাই বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তিন বছর পর তিনি স্থায়ী হন এবং নিয়মিত বেতন পেতেন, এমনকি তাঁর সার্ভিস বুকও তৈরি হয়। অথচ, ২০১৭ সালে অবসরের পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর সার্ভিস নাকি ‘রেগুলার’ হয়নি! ফলে তিনি পেনশন পাবেন না।

তাঁর আইনজীবী ইন্দ্রদীপ পাল নথিপত্র দিয়ে আদালতে দেখান যে, স্বপন দেবনাথের কাছে স্থায়ী চাকরির সমস্ত প্রয়োজনীয় নথি আছে। যদিও সরকারপক্ষ আদালতে দাবি করে যে, ২০০৯ সালে ওই পদটি অবলুপ্ত হয়ে গেছে। এই দাবি শুনে বিচারপতি কান্ত রাজ্য ও পুরসভার ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। আদালতের বক্তব্য, “একজন ব্যক্তি এত বছর সরকারের হয়ে সার্ভিস দিলেন। আর এখন সরকার তাঁর প্রাপ্য না দিয়ে তাঁকে আইনের দরজায় কড়া নাড়তে বাধ্য করছে!”

আদালত আরও জানায়, সরকার ও বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের উচিত ছিল এতদিন ধরে সার্ভিস দেওয়া কর্মীকে বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচানো এবং তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা না করে, তাকে বঞ্চিত করতে পদ্ধতিগত প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যা কোনো জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাছ থেকে কাম্য নয়। আদালত পুরসভাকে নির্দেশ দিয়েছে, ওই কর্মীর যাবতীয় নথির ত্রুটি সংশোধন করে আট সপ্তাহের মধ্যে তাঁর পেনশন চালু করতে হবে।

চুঁচুড়া পুরসভার ১৪৮ জন কর্মীর ভাগ্য নির্ধারণ
অন্যদিকে, চুঁচুড়া পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী দিলীপ হাঁড়ির মামলায় বিচারপতি কান্ত রাজ্য ও বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের প্রবল সমালোচনা করে সমগ্র রাজ্যে অবসরপ্রাপ্ত এমন ১৪৮ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর পেনশন ছ’সপ্তাহের মধ্যে চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এই রায়গুলি প্রমাণ করে যে, সাধারণ কর্মীদের অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগ কতটা সংবেদনশীল। এই নির্দেশগুলি অন্যান্য বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, রাজ্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদালতের নির্দেশ পালন করে কিনা।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy