ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের দেশের জনবিন্যাস (Demographics) পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মোদী এই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেন, যা এই বিষয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের দীর্ঘদিনের দাবিকে আরও জোরদার করল। তাঁর দাবি, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যায় তারতম্য ঘটছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, “আমাদের জনবিন্যাস বদলাতে ষড়যন্ত্র চলছে। অনুপ্রবেশের কারণে আমাদের জাতীয় সুরক্ষা যতটা বিপজ্জনক, এখন তার থেকেও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে জনবিন্যাসের বদল। ফলে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের আদর্শও নষ্ট হচ্ছে।”
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ: গত আগস্ট মাসের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও মোদী ‘ষড়যন্ত্র করে ভারতের জনবিন্যাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা’র অভিযোগ তুলেছিলেন।
রাজ্য সরকারের ভূমিকা: কৌশলে তিনি অভিযোগ করেন যে, এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজ্যের শাসক দলের ভূমিকা রয়েছে।
‘ভিশন ডেমোগ্রাফি’ মিশন: জনবিন্যাস পরিবর্তনকে জাতীয় নিরাপত্তার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ দাবি করে মোদী ‘ভিশন ডেমোগ্রাফি’ মিশন ঘোষণার মাধ্যমে সীমান্ত সুরক্ষার সঙ্গে জনবিন্যাসকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও অতীতে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যে জনবিন্যাসের পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
নিবিড় ভোটার সমীক্ষা ও রাজনীতি
নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা (SIR) শুরু করেছে, যার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ‘ভিশন ডেমোগ্রাফি’-র যোগ রয়েছে বলে দাবি করছে বিরোধী শিবির।
বিহারে শুরু, এরপর পশ্চিমবঙ্গ: সামনে বিহার বিধানসভা নির্বাচন থাকায় সবার আগে সেখানে এসআইআর করা হয়েছে। এরপরেই এই সমীক্ষা হওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গে।
বিজেপির যুক্তি: বিজেপির যুক্তি, ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশকারীরা রয়েছে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে। তাদের চিহ্নিত করতেই এই প্রক্রিয়া।
বিরোধীদের আশঙ্কা: এই সমীক্ষার ফলে সীমান্তবর্তী এলাকায় বহু ভোটারের নাম বাদ পড়তে পারে, যা জাতীয় রাজনীতিতে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
জনসুমারির পরিসংখ্যান কী বলছে?
জনসুমারির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি ছিল:
দশক সীমান্তবর্তী জেলায় বৃদ্ধির হার সীমান্তবর্তী নয় এমন জেলায় বৃদ্ধির হার
১৯৯১-২০০১ ২২ শতাংশ ১৪ শতাংশ
২০০১-২০১১ ১৬.২ শতাংশ ১১.৬ শতাংশ
ধর্মভিত্তিক বৃদ্ধির হারেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়:
দশক সীমান্তবর্তী জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি সীমান্তবর্তী জেলায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি
১৯৯১-২০০১ ১৮.৫ শতাংশ ২৮.১ শতাংশ
২০০১-২০১১ ১১.৮ শতাংশ ২৩.৮ শতাংশ
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আটক হওয়া অনুপ্রবেশকারী ভিনদেশি নাগরিকদের সংখ্যা (যেমন ২০১৯-২২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা সীমান্তে নজরদারিতে ফাঁকফোকর থাকার বা দীর্ঘমেয়াদী অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকার প্রশ্ন তুলছে।
আইডেন্টিটি পলিটিক্স: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচন অনেকটাই আইডেন্টিটি পলিটিক্স-এর উপরে দাঁড়িয়ে হতে চলেছে। বিজেপি মনে করছে, বিরাট সংখ্যক অবৈধ নাগরিক এ রাজ্যের শাসক দলকে ভোট দিচ্ছে।
বিজেপি-আরএসএস-এর ভাবনা: বিশ্লেষক শুভময় মৈত্রর মতে, বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্রবাদী ভাবনা থেকে মোদীর অনুপ্রবেশের কথা তোলা স্বাভাবিক। তাদের কাছে হিন্দু রাষ্ট্রবাদের অগ্রগতির জন্য অনুপ্রবেশ বন্ধ হওয়া জরুরি।
ভোটাধিকার বাতিল: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তীর মতে, অনুপ্রবেশকারীদের ভোটাধিকার থাকবে না এমন পদ্ধতি বিজেপি নিতে চাইছে।
ঐতিহাসিক উদ্বেগ: বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ তৃণমূল-সহ বিরোধীদের আক্রমণ করে বলেন, জ্যোতি বসু এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারাও অতীতে অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৫ সালে লোকসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় এক কোটিরও বেশি বিদেশি থাকার দাবি তুলেছিলেন।
বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
অনুপ্রবেশ যদি হয়েই থাকে, তবে বিএসএফের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল-সহ অন্য বিরোধীরা। তাদের দাবি, গত ১১ বছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কেন অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারলেন না। অন্যদিকে, বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ দাবি করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল বিএসএফের সঙ্গে সহযোগিতা করে না এবং জমি না দেওয়ায় পাহারা দেওয়া কঠিন হচ্ছে।
মোটকথা, প্রধানমন্ত্রীর জনবিন্যাস পরিবর্তন সংক্রান্ত মন্তব্য এবং নির্বাচন কমিশনের এসআইআর উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি বড়সড় মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।