আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি ৬০ বিলিয়ন ডলার! পুটিন সফরে কীভাবে সামরিক চুক্তি ও তেলের নির্ভরতা কমিয়ে বাণিজ্য বাড়াতে চাইছে ভারত?

ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং প্রবল ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের আবহেও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহাসিক সখ্য অবিচল। প্রাক্তন সোভিয়েত আমল থেকেই যে বন্ধুত্বের শুরু, তা এখনো অটুট। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের ভারত সফর সেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বকে আরও একবার প্রমাণ করে দিচ্ছে।

ভারতের সেনা বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে (DW) জানিয়েছেন, পুটিনের এই সফর বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সফরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং এর বাণিজ্যিক তাৎপর্য — দুটি দিক থেকেই বিশ্লেষণ করা জরুরি।

সামরিক সম্পর্কের নতুন সমীকরণ:

ঐতিহাসিক নির্ভরতা: ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ভারত রাশিয়ার থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম কিনত। ২০০২ সালে তা ৮৯ শতাংশে পৌঁছেছিল।

বিকেন্দ্রিকরণ: ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সামরিক সরঞ্জাম কেনার বাজার বিকেন্দ্রিত হয়। ভারত ফ্রান্স ও আমেরিকার মতো দেশগুলির সঙ্গে চুক্তি করেছে। পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনেও জোর দিয়েছে। ফলে ২০১৯ সালের মধ্যে রাশিয়ার থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৩৮ শতাংশে, যা গত পাঁচ বছরে ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

তাৎপর্য অবিচল: সামরিক সরঞ্জাম কেনার হার কমলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাশিয়ার তাৎপর্য কমেনি। কারণ ভারত এখনো রাশিয়ার থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, আধুনিক নেক্সট জেনারেশন মিসাইল, পারমাণবিক চুল্লি এবং পরমাণু অস্ত্র বহনকারী সাবমেরিনের মতো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামগুলি কেনে।

পুটিনের এবারের সফরে দুই দেশ এস-৫০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং নৌবহরের অস্ত্রের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির পথে হাঁটতে পারে। তবে ভারত চাইছে, যৌথ উৎপাদনে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে, যেখানে প্রযুক্তি ভাগ করে নেবে রাশিয়া।

তেল ও বাণিজ্যের ঘাটতি:

তেল আমদানি: ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনেছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র হওয়ায় ভারত এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তেল ছাড়াও পরমাণু চুল্লি, রাসায়নিক ও সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাশিয়া ভারতকে বিক্রি করে।

বাণিজ্য ঘাটতি: ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, রাশিয়া থেকে ভারত আমদানি করে প্রায় ৬০-৬৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যার বিপরীতে রপ্তানি করে মাত্র ৪-৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, একটি বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি (ট্রেড ডেফিসিট) রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরীর মতে, ভারত এই সফরে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ খুঁজবে। বর্তমানে ভারত রাশিয়ায় মূলত কৃষিজাত দ্রব্য ও ওষুধের কাঁচামালের মতো লো-লেভেল পণ্য রপ্তানি করে। তবে ভারত এখন রত্ন ও গয়না এবং বস্ত্রের মতো প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য রাশিয়ার বাজারে প্রবেশের জন্য সরকারি উদ্যোগ চাইছে।

ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব:

ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়া বিরোধী জোটের বিপরীতে গ্লোবাল সাউথের একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছে, যার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হলো ব্রিকস। এই কঠিন সময়ে পুটিনকে স্বাগত জানিয়ে ভারত স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, গ্লোবাল সাউথের মঞ্চে ভারত রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবেই মনে করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমা বিশ্ব এই বার্তাকে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy