রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় এক উদ্বেগজনক চিত্র সামনে এসেছে। স্কুল শিক্ষা দফতরের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য – পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩৫০টি সরকারি অনুমোদিত স্কুলে গত পাঁচ বছর ধরে একজনও পড়ুয়া নেই। এই ‘পড়ুয়াবিহীন’ স্কুলগুলির ভবিষ্যৎ এবং তাদের অব্যবহৃত ভবনগুলি কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে এখন রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে।
ক্ষয়িষ্ণু ছাত্রসংখ্যা: একটি আঞ্চলিক সংকট
শিক্ষা দফতরের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের ২৩টি জেলাতেই প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের এমন বহু স্কুল রয়েছে, যেখানে ২০২০ সালের পর থেকে কোনো নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। এর মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো উত্তর ২৪ পরগনা জেলা, যেখানে একাই ৬০টি এমন সরকারি স্কুল চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে কোনো পড়ুয়াই নেই। এই ঘটনা শুধু অবাক করার মতো নয়, বরং গ্রামীণ বা নির্দিষ্ট কিছু শহরাঞ্চলে শিক্ষার প্রতি আগ্রহে ঘাটতি, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, নাকি শিক্ষা পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
অকেজো ভবন: সম্পদ নাকি বোঝা?
দীর্ঘদিন ধরে পড়ুয়া না থাকার কারণে এই স্কুলগুলির ভবনগুলি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। সরকারি সম্পদ হিসেবে এগুলি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহন করছে, অথচ কোনো শিক্ষামূলক কাজে আসছে না। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজ্য সরকার এখন জেলাগুলির কাছে প্রস্তাব চেয়েছে যে, এই অব্যবহৃত বিল্ডিংগুলি অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা। প্রাথমিক আলোচনায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র স্থাপন বা অন্য কোনো সরকারি পরিষেবা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে।
কেন এই শূন্যতা?
শিক্ষাবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতির পেছনের কারণ অনুসন্ধান করছেন। কিছু সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
শিক্ষার্থী কমে যাওয়া: সংশ্লিষ্ট এলাকায় জন্মহার কমে যাওয়া বা অভিভাবকদের উন্নত শিক্ষার জন্য সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি।
অন্যত্র চলে যাওয়া: কাজের সন্ধানে বা উন্নত জীবনযাত্রার আশায় পরিবারগুলির গ্রাম ছেড়ে শহর বা অন্য রাজ্যে পাড়ি জমানো।
শিক্ষার মানের অভাব: এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনার মান নিয়ে অভিভাবকরা সন্তুষ্ট নন, এমন অভিযোগও থাকতে পারে।
অবস্থানগত সমস্যা: কিছু স্কুল এমন দুর্গম বা বিচ্ছিন্ন স্থানে অবস্থিত হতে পারে যেখানে শিক্ষার্থীদের পৌঁছানো কঠিন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: কার্যকর ব্যবহার জরুরি
রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন। কারণ, জনগণের অর্থে নির্মিত এই পরিকাঠামো ফেলে রাখাটা একদিকে যেমন সম্পদের অপচয়, তেমনই এলাকার মানুষের জন্য একটি সুযোগ হারানো। জেলাগুলির কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলির ভিত্তিতে শিক্ষা দপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যৌথভাবে একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই স্কুলগুলির ভবনগুলোকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, কমিউনিটি হল, দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, বা স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা গেলে তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। এই উদ্যোগ যদি সফল হয়, তাহলে এটি কেবল অব্যবহৃত সম্পদের সদ্ব্যবহারই নয়, বরং প্রান্তিক এলাকার মানুষের জীবনে নতুন সুযোগ তৈরির একটি মডেলও হয়ে উঠবে।