পথকুকুরের কামড়ে এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। আদালতের নির্দেশে দিল্লি এবং এর পার্শ্ববর্তী শহর যেমন গুরগাঁও, নয়ডা ও গাজিয়াবাদে এখন থেকে কোনো পথকুকুর আর রাস্তায় থাকতে পারবে না। সব কুকুরকে অবিলম্বে সরিয়ে নিয়ে শেল্টারে রাখার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এর ফলে প্রাণী অধিকার কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আদালত এই পরিস্থিতিকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে উল্লেখ করে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করে। এর কারণ ছিল গত ২৮ জুলাই দিল্লির পুঠ কালান এলাকায় ছয় বছরের শিশু ছবি শর্মার মৃত্যু। জানা গেছে, ৩০ জুন তাকে এক কুকুর কামড়ায় এবং ২৬ জুলাই চিকিৎসার পর সে মারা যায়। এই ঘটনার পর আদালতের নজরে আসে দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকায় শত শত কুকুর কামড়ানোর ঘটনা।
কঠিন নির্দেশের বিস্তারিত:
- দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন: আদালত দিল্লি-এনসিআরের পৌরসভাগুলোকে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ কুকুর রাখার মতো আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মী থাকবেন, যারা কুকুরদের নির্বীজকরণ ও টিকাকরণের দায়িত্বে থাকবেন।
- হেল্পলাইন চালু: কুকুর কামড়ানোর ঘটনা জানানোর জন্য একটি হেল্পলাইন চালু করতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কুকুরকে ধরে আনতে হবে।
- সিসিটিভি নজরদারি: আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি নজরদারি থাকবে, যাতে কোনো কুকুরকে কেন্দ্র থেকে বাইরে ছাড়া না হয়।
- আইনি কড়া ব্যবস্থা: যদি কেউ এই প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হবে। প্রয়োজনে এই অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ বাহিনী গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিতর্ক ও বাস্তবতার প্রশ্ন:
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে অনেকেই স্বাগত জানালেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। প্রাণী অধিকার কর্মী এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাণী কল্যাণ কর্মী দময়ন্তী সেনের মতে, দিল্লিতে প্রায় ৩ লক্ষ কুকুর আছে। এত বিশাল সংখ্যক কুকুরের জন্য স্বল্প সময়ে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তিনি নির্বীজকরণ ও টিকাকরণ কর্মসূচিতে জোর দেন। তাঁর মতে, এ দুটি কর্মসূচি সঠিকভাবে পালন করলে কুকুরের সংখ্যা ও আগ্রাসী মনোভাব দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
কলকাতার প্রাণী অধিকার সংগঠন ‘ফারফোক্স’-এর এস কে বাসিতের মতেও, মাত্র ছয় সপ্তাহে এত কুকুরকে শেল্টারে সরানো সম্ভব নয়। তিনি নিয়মিত নির্বীজকরণ ও টিকাকরণের উপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন যে নির্বীজকরণের মাধ্যমে পুরুষ কুকুরের আগ্রাসী মনোভাবও কমানো যায়।
প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা:
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রাণী অধিকার কর্মী মেনকা গান্ধী এই নির্দেশের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লিতে ৩ লক্ষ কুকুরকে আশ্রয় দিতে ১৫,০০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে, যা বাস্তবসম্মত নয়। পিপল ফর দ্য এথিকাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস (PETA)-এর মিনি আরাভিন্দনও মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত কুকুর ও মানুষ উভয়ের জন্যই সমস্যা তৈরি করবে। অভিনেতা জন আব্রাহাম দিল্লির কুকুরকে ‘দিল্লিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। রাহুল গান্ধী এক্স-এ (আগের টুইটার) লিখেছেন, এই নির্দেশ ‘অমানবিক ও বিজ্ঞানবিরোধী’ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শেল্টার, নির্বীজকরণ, টিকাকরণ ও কমিউনিটি কেয়ারের মতো সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন।
সব মিলিয়ে, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পর ছয় সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আদালত জানতে চেয়েছে, এই সময়ের মধ্যে সরকার ও পুরসভা কতটা কাজ করতে পারল। এখন সবার চোখ সেদিকেই, এই কঠিন নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়, তা দেখার জন্য।