রাশিয়ার তেল আমদানি নিয়ে ভারত-আমেরিকা টানাপোড়েন, ভারতের স্পষ্ট বার্তা – ‘জাতীয় স্বার্থই অগ্রাধিকার’

রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কেনার বিষয়ে ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে, বিশেষত আমেরিকার, তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা যখন রাশিয়ান তেল ও গ্যাস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকে ক্ষুব্ধ করেছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা রাশিয়ার তেল ক্রেতাদের ওপর ২৫% শুল্ক এবং অতিরিক্ত জরিমানা আরোপের ঘোষণা করেছে।

তবে, ভারত তার অবস্থানে অটল রয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল স্পষ্ট জানিয়েছেন, ভারত তার জ্বালানি নীতি জাতীয় স্বার্থ এবং বাজারের শক্তির উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করে। তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের জ্বালানি চাহিদা মেটানোই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। এর জন্য আমরা কোনও বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না।” এই মন্তব্য ভারতের সার্বভৌম জ্বালানি নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার স্বাধীন অবস্থানের প্রতিফলন ঘটায়।

ভারতের রাশিয়ার উপর নির্ভরতা:

ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক ও কৌশলগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে ভারতের মোট তেল আমদানির ৩৫-৪০% রাশিয়া থেকে এসেছে। মে ২০২৫-এ ভারত দৈনিক ১.৯৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করেছে, যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তেলের পাশাপাশি, ২০২৩ সালে ভারত রাশিয়া থেকে ১০.০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন তাপীয় কয়লা (মোট জ্বালানি আমদানির ৬%) আমদানি করেছে।

এছাড়াও, রাশিয়া ভারতের কৃষিখাতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার, যেমন ইউরিয়া, সরবরাহকারী অন্যতম প্রধান দেশ। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও রাশিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। গত দুই দশকে ভারত রাশিয়া থেকে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র, যার মধ্যে S-400 বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ এবং ডুবোজাহাজ উল্লেখযোগ্য, ক্রয় করেছে।

রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করলে কী হবে?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়, তবে দেশের অভ্যন্তরে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হতে পারে। এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়বে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে ভারতকে দেশীয় তেল উৎপাদন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, গায়ানা এবং কানাডার মতো অন্যান্য দেশ থেকে তেল আমদানির বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।

আমেরিকার আপত্তির কারণ:

আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলির মূল অভিযোগ হলো, রাশিয়ার তেল বিক্রি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মস্কোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তাদের যুক্তি, ভারতের রাশিয়ার তেল কেনা রাশিয়ান অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে, যা ইউক্রেনে তাদের আগ্রাসনকে দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করছে। এই অবস্থান আমেরিকার রাজনৈতিক লক্ষ্যের পরিপন্থী।

তবে, ভারত তার নিজস্ব জ্বালানি সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তার বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই টানাপোড়েন ভারতের স্বাধীন বিদেশনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy