ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্কের প্রতীক যেমন ভাইফোঁটা, তেমনই রাখি বন্ধন উৎসব। তবে এই উৎসব কেবল ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ারও এক অনন্য মাধ্যম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এই রাখিকেই হাতিয়ার করেছিলেন। ৩০শে আশ্বিন, রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে কলকাতার রাস্তায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ রাখি পরানোর কথা কেন ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? এই প্রথা চালু হলো কীভাবে?
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, আলেকজান্ডার যখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে ভারতে আসেন, তখন তার সামনে পড়ে পুরু রাজ্য। পুরুরাজা আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার না করায় যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে আলেকজান্ডার পরাজিত হন এবং পুরুরাজের হাতে বন্দি হন। সেই সময়ে আলেকজান্ডারের স্ত্রী নাকি স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে পুরুরাজের হাতে রাখি পরিয়ে তাকে ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ, সেই সময়ও ভারতে এই রাখি বন্ধন উৎসবের প্রচলন ছিল।
রাখি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনিও। রামায়ণ অনুসারে, বনবাসে যাওয়ার আগে রাম সমগ্র বানর সেনাকে ফুল দিয়ে হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন, যা তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে। এছাড়াও, দেবী লক্ষ্মী নাকি পাতাললোকে বলির হাতে রাখি পরিয়ে তাকে ভাই পাতিয়েছিলেন। এরপর উপহার হিসেবে স্বামী বিষ্ণুকে স্বর্গে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
মহাভারতের একটি বিখ্যাত ঘটনাও এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত। দ্রৌপদী আপন বোন না হয়েও শ্রীকৃষ্ণের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা এই স্নেহ দেখে অভিমানভরে কারণ জানতে চাইলে কৃষ্ণ বলেন, ‘যথাসময়ে এর কারণ তুমি বুঝতে পারবে।’ এর কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত ঝরছিল। সুভদ্রা রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সাধারণ কাপড়ের খোঁজে ব্যস্ত থাকলেও তা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় দ্রৌপদী সেখানে এসে দেখেন কৃষ্ণের হাত থেকে প্রবল রক্তপাত হচ্ছে। দেরি না করে তিনি নিজের মূল্যবান রেশম শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন, এবং রক্তপাত বন্ধ হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রাকে ডেকে বলেন-‘এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি?’
এইভাবেই রাখি বন্ধন উৎসব কেবল ভাই-বোনের সম্পর্ক নয়, বরং ভালোবাসা, সম্প্রীতি, এবং একে অপরের প্রতি সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।