রাখিবন্ধন, ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্ক উদযাপনের এক প্রাচীন উৎসব। যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে, যা এখন শুধু হিন্দুদের নয়, বরং ভারতের এক জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই দিনে বোন বা দিদি তার ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় কব্জিতে রাখির সুতো বেঁধে দেন। এই সুতোয় যে তিনটি গিঁট দেওয়া হয়, তার নেপথ্যে রয়েছে এক গভীর তাৎপর্য। অনেকে এর কারণ না জানলেও, যুগ যুগ ধরে এই প্রথা চলে আসছে। আসুন জেনে নিই এই তিনটি গিঁটের তাৎপর্য এবং রাখিবন্ধন সম্পর্কিত কিছু ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনি।
রাখির তিনটি গিঁটের তাৎপর্য:
রাখির সুতোয় দেওয়া এই তিনটি গিঁটকে ত্রিদেব— ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
প্রথম গিঁট: এটি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার প্রতীক। এর মাধ্যমে ভাইয়ের জীবনে অখণ্ড যাত্রা, সৌভাগ্য ও শক্তিতে পরিপূর্ণতা লাভের কামনা করা হয়।
দ্বিতীয় গিঁট: এটি ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের রক্ষাকর্তা। এর মাধ্যমে ভাইকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করার, সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য কামনার আশীর্বাদ চাওয়া হয়।
তৃতীয় গিঁট: এটি দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতীক। এই গিঁটটি সমস্ত দুষ্টশক্তি ও অশুভ প্রভাব থেকে ভাইকে রক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়।
এছাড়াও, এই তিনটি গিঁটকে ভাই-বোনের পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং সুরক্ষার প্রতীক হিসেবেও মান্যতা দেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক প্রেক্ষাপট:
রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গভঙ্গ: বাঙালির কাছে রাখিবন্ধনের রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে রাখিবন্ধনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
রানি কর্ণাবতী ও হুমায়ুন: কিংবদন্তি অনুসারে, চিতোরের রানি কর্ণাবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়েছিলেন, যাঁর সাহায্যে তিনি তাঁর রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন।
দ্রৌপদী ও কৃষ্ণ: মহাভারতে দ্রৌপদী এবং শ্রীকৃষ্ণের ভ্রাতৃপ্রেমের কাহিনি সুবিদিত। কৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত ঝরলে দ্রৌপদী নিজের মূল্যবান শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে তাঁর হাত বেঁধে দেন। কৃষ্ণ দ্রৌপদীর এই ভালোবাসা দেখে তাঁকে আজীবন রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
গণেশ ও সন্তোষী: একটি পৌরাণিক কাহিনিতে বলা আছে, রাখির দিনে গণেশের বোন তাঁকে রাখি পরালে গণেশের দুই ছেলে শুভ ও লাভ হিংসা করে। তাদের বায়না মেটাতে গণেশ দিব্যাগ্নি থেকে কন্যা সন্তোষীর জন্ম দেন, যিনি শুভ ও লাভের হাতে রাখি পরান।
লক্ষ্মী ও বলিরাজা: দৈত্যরাজা বলির হাতে রাখি পরিয়ে লক্ষ্মী দেবী তাঁর স্বামী বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি রাখিবন্ধন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
সামনেই রাখি পূর্ণিমা। এই উৎসব শুধু একটি সুতোয় বাঁধা প্রথা নয়, বরং এটি স্নেহ-ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং অটুট সম্পর্কের এক উজ্জ্বল প্রতীক। একটি সুতোয় বাঁধা পড়ে থাকে আজন্ম থেকে আমৃত্যু ভাইবোনের সম্পর্ক।