বুধবার সকালে এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হল মহেশতলা। রবীন্দ্রনগর থানা সংলগ্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের উন্মত্ত তাণ্ডবে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা অঞ্চল। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের বাইকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, একের পর এক বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয় এবং পুলিশের গাড়িতে পাথরের আঘাতে কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বিভীষিকাময় এই পরিস্থিতিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে চলে লাগাতার ইটবৃষ্টি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলেও প্রথমে তা দুষ্কৃতীদের থামাতে পারেনি, বরং তারা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
থমথমে পরিবেশ, জারি ১৪৪ ধারা
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বৃহস্পতিবার সকালেও রবীন্দ্রনগর এলাকায় চাপা উত্তেজনা ও থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন সেক্টর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে থানা ও সংলগ্ন এলাকায়। অলিগলিতে চলছে পুলিশের রুট মার্চ, কিন্তু বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ এবং রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুবই কম। সমগ্র এলাকাজুড়ে এখনো চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
গ্রেফতার ১৮, আহত পুলিশকর্মী
বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মোট ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, গত দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দোকান বসানো নিয়ে বিবাদের সূত্রপাত হয়, যা দ্রুতই এক ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। হামলায় একাধিক পুলিশকর্মী আক্রান্ত হন, এমনকি ইটের আঘাতে একজন মহিলা পুলিশকর্মীও গুরুতর আহত হন। প্রথমদিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন না থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুটা সময় লেগে যায়, যার জেরে মহেশতলার রবীন্দ্রনগর থানা সংলগ্ন এলাকা বেশ কিছুক্ষণ দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।
রাজনৈতিক চাপানউতোর: শাসক-বিরোধীর তরজা
মহেশতলার এই ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক মহলে তীব্র চাপানউতোর শুরু হয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান কলকাতা পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে শাসক দলকে তীব্র কটাক্ষ করেছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এই ঘটনার পর মমতা সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন।
এদিকে, মহেশতলা কাণ্ডের জেরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আজ বৃহস্পতিবার বিধানসভা অচল করার ডাক দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় ভবানীভবনের সামনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, “মহেশতলায় চরম নৈরাজ্যের ছবি ধরা পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এসি ঘরে বসে আছেন, রাজ্যের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। পুলিশের ৩০-৩৫ জন সদস্য আহত, ১২টি গাড়ি জ্বালানো হয়েছে।” শুভেন্দু আরও দাবি করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হোক। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার তার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করায় তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেন।
তবে, মহেশতলার ঘটনা নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। তিনি এটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ উল্লেখ করে পুলিশের দায়িত্বশীলতার প্রশংসা করেন। কুণাল বলেন, “কখনও কখনও এ ধরনের ঘটনা হয়, পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট সংবেদনশীলতার সঙ্গে কড়া মনোভাব নিয়ে গোটা বিষয়টা দেখছে। পুলিশ আধিকারিক জখম হয়েছেন। কিন্তু প্রশাসন এখানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। এমন কিছু করেনি যাতে পরিস্থিতি আরও বেড়ে যায় বা জটিল হয়ে যায়।” এরপরই তিনি ঘটনায় ‘প্ররোচনার’ অভিযোগ তোলেন এবং এমন একটি ঘটনাকে আর না বাড়ানোর অনুরোধ করেন। কুণাল বলেন, “এটাকে প্ররোচনা দিয়ে, নানা বিবৃতি দিয়ে, অকারণ সেসব নিয়ে ঝামেলা করা তো ঠিক নয়। উত্তেজনা ছড়ানোর তো কোনো মানে নেই। এটা তো নতুন না। দুটো গোষ্ঠী, একটা পাড়াতে, ক্লাবে, মত পার্থক্য হয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা। সেটা আরও বাড়াব না পুলিশের ওপর ছেড়ে দেব!”
মহেশতলার পরিস্থিতি কবে নাগাদ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে, এবং এই ঘটনা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়, এখন সেটাই দেখার।