‘মেয়ের টাকায় খাই’ অপবাদ সইতে না পেরে ৫টি গুলি, রাধিকা খুনে ভয়ঙ্কর স্বীকারোক্তি বাবার!

সকাল সাড়ে দশটা। রান্নাঘরে পিঠ ফিরিয়ে রান্না করছিল মেয়েটা। পেছন থেকে বাবা এসে পর পর তিনটি গুলি চালাল। মেয়েটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার পরেও থামল না সে। তারপরেও আরও দু’টি গুলি। মোট পাঁচটি! হরিয়ানার গুরুগ্রামে তরুণ টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা যাদবের নৃশংস খুনের ঘটনার হাড়হিম করা বর্ণনা লেখা আছে FIR-এর ছত্রে ছত্রে। কিন্তু এই নির্মমতার নেপথ্যে কী? পুলিশি জেরায় উঠে এসেছে নিহত রাধিকার বাবা দীপক যাদবের তীব্র পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং এক অসুস্থ ‘সম্মানবোধ’-এর কাহিনি।

আর্থিক স্বাধীনতা, পুরুষতান্ত্রিক ইগোর সংঘাত:
গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৭-এ নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকতেন রাজ্যস্তরের টেনিস খেলোয়াড় রাধিকা। সম্প্রতি একটি টেনিস অ্যাকাডেমি খুলেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, ইনস্টাগ্রাম রিলস এবং ভিডিও থেকেও ভালো অর্থ উপার্জন করতেন, যা তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছিল। কিন্তু এই আর্থিক স্বাধীনতাই তার বাবা দীপক যাদবের কাছে হয়ে উঠেছিল তীব্র অপমানের কারণ, যা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।

ঘটনার বীভৎসতা:
এফআইআর অনুযায়ী, ঘটনার দিন গুলির শব্দ শোনা মাত্রই দীপকদেরই বাড়ির এক তলায় থাকা রাধিকার কাকা ছুটে যান উপরে। সেখানে তিনি যা দেখেন, তা বীভৎস। রাধিকা রান্নাঘরের মেঝেতে রক্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে কাকা ও তার ছেলে রাধিকাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

পুলিশি জেরায় দীপকের স্বীকারোক্তি: পুরুষতান্ত্রিক দম্ভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ
পুলিশি জেরায় অভিযুক্ত দীপক যাদব তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তার স্বীকারোক্তি রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। দীপক পুলিশকে জানিয়েছে, তার গ্রামের লোকজন, অর্থাৎ ওয়াজিরাবাদের বাসিন্দারা তাকে প্রায়শই খোঁটা দিত এই বলে যে সে ‘মেয়ের পয়সায় খায়’। দীপক বলেছে, “আমি যখন ওয়াজিরাবাদে দুধ আনতে যেতাম, ওখানেও লোকে আমায় খোঁটা দিত। বলত আমি নাকি মেয়ের পয়সায় খাই। এই ব্যাপারটায় আমার ভীষণ খারাপ লাগত, মাথা গরম হয়ে যেত। কিছু লোক তো আমার মেয়ের চরিত্র নিয়েও কথা বলত। আমি বলেছিলাম ওকে টেনিস অ্যাকাডেমিটা বন্ধ করে দে। ও শোনেনি।”

এখানেই শেষ নয়, দীপক পুলিশকে আরও জানিয়েছে, “পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছিল। এটা আমার মান সম্মানের ব্যাপার। আমার মানে লাগছিল। আমার কাছে লাইসেন্সড রিভলভার ছিল। মেয়ে তখন রান্নাঘরে রান্না করছিল। আমি পিছন থেকে ওকে ৩টে গুলি মারি। কোমরে। আমি আমার মেয়েকে খুন করেছি।”

এই বয়ান দীপকের মধ্যে থাকা তীব্র পুরুষতান্ত্রিক দম্ভ এবং সামাজিক কটাক্ষের প্রতি তার অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়। একজন বাবা তার মেয়ের সাফল্যকে গর্বের চোখে না দেখে, সমাজের অপবাদকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিয়ে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে, তা সত্যিই অকল্পনীয়।

মায়ের নীরবতা ও প্রশ্ন:
আশ্চর্যজনকভাবে, নিহতের মা মঞ্জু দেবী এই ঘটনায় কোনও লিখিত বয়ান দিতে অস্বীকার করেছেন। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি ঘরে দরজা বন্ধ করে ছিলেন এবং তার জ্বর ও মাথার যন্ত্রণা ছিল। মায়ের এই নীরবতাও ঘটনার জটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

রাধিকা যাদবের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেবল একটি অপরাধ নয়, এটি সমাজের গভীরে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক অহংকার, নারী বিদ্বেষ এবং সামাজিক কটাক্ষের বিষাক্ত প্রভাবের এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, আধুনিকতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমাজের কিছু অংশে কীভাবে পুরোনো, বিষাক্ত ধারণার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, যার চূড়ান্ত বলি হচ্ছে নির্দোষ প্রাণ।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy