একান্ন সতীপীঠের অন্যতম মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দির। দেবী কিরীটেশ্বরী এখানে রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিত হন। হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন এই মন্দিরকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে এক আশ্চর্য ঐতিহ্য এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক বিরল নজির।
চোখ বাঁধা পুরোহিত, শিলারূপেই পূজা
কিরীটেশ্বরী মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই, একটি শিলা মূর্তিকেই দেবী রূপে পূজা করা হয়। এই মন্দিরের সবচেয়ে বিশেষ প্রথাটি হলো মহাষ্টমীর দিন মাকে স্নান করানো।
গোপন স্নান: প্রতি বছর অষ্টমীর পুজোর আগে দেবীকে স্নান করানো হয়। এই সময় গর্ভগৃহের দরজাও বন্ধ রাখা হয়।
চোখ বাঁধা: সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, স্নান করানোর ভার যাঁর ওপর থাকে, সেই পুরোহিত নেপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ কাপড়ের ফেট্টি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে তিনি মায়ের রূপ দর্শন করতে না পারেন।
মন্দির কমিটির সদস্য মনোতোষ অধিকারী জানান, দশ মৃত্তিকা লেপনের পর ব্রহ্মপুত্র, মানস সরোবর, ভাগীরথী-সহ সাত সমুদ্রের জল ও গোলাপজল মিশিয়ে দেবীকে স্নান করানো হয়। এরপর নতুন লাল বেনারসি শাড়ি ও বিভিন্ন অলঙ্কারে সাজানোর পর শুরু হয় যজ্ঞ।
মুসলিম ভক্তের পুকুর থেকে আসে মৎস্য ভোগ
কিরীটেশ্বরী মন্দির যে সর্বধর্ম সমন্বয়ের অন্যতম নজির, তা স্পষ্ট হয় ভোগের আয়োজনে।
মৎস্য ভোগ: অষ্টমীতে দেবীকে মৎস্য ভোগ দেওয়া হয়। এই মাছ আসে প্রয়াত আবদুল হাকিমের বাড়ির পুকুর থেকে। অষ্টমীর সকালে জাল ফেলে মাছ ধরে, সেই পরিবারের কোনও এক সদস্য স্নান করে নতুন পোশাক পরে সেই মাছ নিয়ে আসেন।
জমি দান: মনোতোষ অধিকারী জানান, আবদুল হাকিম ও তাঁর পরিবার কিরীটেশ্বরী মায়ের ভক্ত। হাকিম তাঁর দু’কাঠা জমি মন্দির কর্তৃপক্ষকে দান করার কথা বলেছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পরে তাঁর ছেলেরা সেই জমি মন্দির কমিটিকে দানপত্র করে দেন।
আবদুল হাকিমের নাতি মহম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, “নামাজ-রোজা যেমন করি, তেমনি কিরীটেশ্বরী মাকেও মানি।” তিনি আরও জানান, দর্শনার্থীদের জন্য তিনি তাঁর অবসরকালীন টাকায় জলের ট্যাঙ্ক নির্মাণ করেছেন— যা ভারতের চিরায়ত ঐতিহ্য বহন করে।
১০-১২ হাজার মানুষের পাত পেড়ে খাওয়া
অষ্টমীর দিনে কিরীটেশ্বরী মন্দিরে প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের ভোগ রান্না হয় এবং পুজোর পরে সেখানে পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম, মালদহ, নদিয়া জেলার মানুষও এই মহোৎসবে ভিড় জমান।
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এখানে সতীর মুকুটের কণা বা কিরীটকণা উড়ে এসে পড়েছিল। হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এই মন্দির একসময় রানি ভবানী রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং পরে লালগোলার মহারাজা দর্পনারায়ণ নতুন করে এটি নির্মাণ করেন।