ভারতের প্রথম মহিলা গুপ্তচর ‘নীরা আর্য’, জেনেনিন তার আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার গল্প

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কেবল পুরুষ বিপ্লবীদের বীরত্বের কাহিনীতে সীমাবদ্ধ নয়। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের পাশাপাশি বহু অদম্য নারীও অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। এমনই এক সাহসী নারীর নাম নীরা আর্য, যিনি দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকেও উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেননি। ভারতের প্রথম মহিলা গুপ্তচর হিসেবে তাঁর অবদান আজও অনেকের কাছে অজানা।

উত্তরপ্রদেশের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নীরা আর্যর বিয়ে হয়েছিল শ্রীকান্ত জয়সওয়াল নামে এক ব্রিটিশ অনুগত পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। একদিকে যখন তাঁর স্বামী দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করছিলেন, তখন নীরার মনে ছিল কেবল দেশপ্রেমের আগুন। এই দেশপ্রেমই তাঁকে এক কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৪০ সালে যখন নীরা জানতে পারেন যে তাঁর স্বামী ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে নেতাজিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছেন, তখন তিনি স্বামীকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। দেশপ্রেমকে জীবনের চেয়েও ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন তিনি।

এই আত্মত্যাগের পর নীরা আর্য ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ ‘ঝাঁসি কী রানি’ রেজিমেন্টে যোগ দেন। তবে তিনি বেছে নেন এক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ— গুপ্তচরবৃত্তি। বিভিন্ন ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং সেইসব গুরুত্বপূর্ণ খবর আজাদ হিন্দ ফৌজকে জানাতেন। নেতাজির গতিবিধি গোপন রাখা এবং শত্রুপক্ষের কার্যকলাপের আগাম খবর দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব।

দুর্ভাগ্যবশত, এক গোপন অভিযানের সময় ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে স্বামী হত্যার অভিযোগ আনা হয়। বন্দি অবস্থায় তাঁর ওপর চলে অমানবিক অত্যাচার। শোনা যায়, ব্রিটিশরা তাঁর বুকে গরম লোহার রড দিয়েছিল, কিন্তু শত অত্যাচারেও তিনি মুখ খোলেননি। নেতাজি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেছিলেন, “আমি নেতাজিকে চিনি না। আমার কর্তব্য দেশের সুরক্ষা, যা জীবনের থেকেও বড়।”

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও ভারতের এই বীর নারীর কথা অনেকের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কোনো সরকারি স্বীকৃতি বা সম্মান তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। জীবনের শেষ দিনগুলোয় তাঁকে দিল্লির রাস্তায় ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে বলে জানা যায়। যে দেশের জন্য তিনি এত আত্মত্যাগ করলেন, সেই দেশই তাঁকে সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও নীরা আর্য কোনো অভিযোগ করেননি। তাঁর জীবন ত্যাগ, দেশপ্রেম এবং সাহসিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ, যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy