ব্রহ্মপুত্রের জল নিয়ে পাকিস্তানের হুমকি বনাম ভারতের বাস্তবতা, চিনের ক্ষমতা কতটা?

সিন্ধু নদের জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের পদক্ষেপের পর দিশেহারা পাকিস্তান এবার চিনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ব্রহ্মপুত্র নদের জল নিয়ে ভারতকে হুমকি দিতে শুরু করেছে। তাদের দাবি, চিন জল বন্ধ করলে নাকি ব্রহ্মপুত্রও শুকিয়ে যাবে। তবে, এই দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্রের জলের মূল উৎস উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ভারী বর্ষণ এবং অসংখ্য শাখা নদীর জল।

মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা দাবি: ব্রহ্মপুত্র ভারতে ঢুকেই ফুলেফেঁপে ওঠে
অসমের মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ব্রহ্মপুত্র ভারতে প্রবেশের পরই ফুলেফেঁপে ওঠে। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে তথ্য দিয়ে বলেছেন, ব্রহ্মপুত্রের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ জলের উৎস ভারতেই রয়েছে। মূলত অসম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশে ভারী বর্ষণ এবং সুবানসিরি, মানস, লোহিত, কামেং, ধানসিরির মতো প্রধান শাখা নদীগুলির জলে পুষ্ট হয় ব্রহ্মপুত্র। এছাড়াও খাসি, গারো এবং জয়ন্তীয়া পাহাড়ের কৃষ্ণানই, দিগারু এবং কুলসির মতো ছোট ছোট নদীর জলও এসে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।

হিমন্ত বিশ্বশর্মা আরও দাবি করেছেন, চিন যদি একান্তই ব্রহ্মপুত্রে জল আসা বন্ধ করেও, সেক্ষেত্রে ভারতের উপকারই হবে। কারণ অতিরিক্ত জল কমে অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতি বছরের বন্যার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। তিনি hydrological data তুলে ধরে বলেন, তুতিংয়ে চিন-ভারত সীমান্তে ব্রহ্মপুত্রের জলের প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ২০০০ থেকে ৩০০০ কিউবিক মিটার থাকে, যেখানে বর্ষার সময়ে গুয়াহাটির মতো অসমের সমতলে সেই প্রবাহই বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০০০ থেকে ২০০০০ কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ড। এর থেকেই বোঝা যায়, ব্রহ্মপুত্র ভারতে প্রবেশ করার পরেই মূলত তার আয়তন বৃদ্ধি পায়।

চিনের পক্ষে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ করা অসম্ভব কেন?
শুধুমাত্র হিমন্ত বিশ্বশর্মার দাবিই নয়, প্রযুক্তিগত, ভৌগোলিক এবং ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলি বিচার করেও বলা যায়, ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ কিছুটা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি বন্ধ করার সুযোগ বা ক্ষমতা চিনের হাতে নেই। এমনকি, গতিপথ আংশিক বদলের প্রভাবও অনেক বড়সড় হতে পারে।

natstratb.org-তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় যে পরিমাণ জল থাকে তার ২২ থেকে ৩০ শতাংশ আসে চিন থেকে। এই প্রতিবেদনের দুই লেখক পি কে সাক্সেনা (ভারতে সিন্ধু জলবণ্টন প্রকল্পের প্রাক্তন কমিশনার) এবং তীর্থ সিং মেহতা (ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদীর জন্য ভারতের জলশক্তি মন্ত্রকের প্রাক্তন কমিশনার) দাবি করেছেন, যেহেতু তিব্বতে বৃষ্টিপাত অথবা তুষারপাতের পরিমাণ খুব বেশি হয় না, সেই কারণেই ব্রহ্মপুত্রের জলে চিনের অবদান খুব বেশি থাকে না।

বরং তাঁরা দাবি করেছেন, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার মাত্র ৬.৭ শতাংশ চিনের ভাগে থাকলেও ব্রহ্মপুত্রের জলের প্রায় ২১ শতাংশ আসে ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে। অন্যদিকে ভারতে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার ৩৪.২ শতাংশ রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রে মোট যে জল এসে মেশে, তার ৩৯ শতাংশই ভারত থেকে আসে বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

চিনের বাঁধ তৈরি এবং ভারতের চিন্তা
ব্রহ্মপুত্রের তিব্বতি নাম ইয়ারলুং সাংপ্রো। সেই নদীর উপরেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে চিন। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে জলবিদ্যুৎ তৈরি করতে নদীর গতিমুখগুলিকে বিভিন্ন সুড়ঙ্গের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। নদীর এই গতিপথ বদলের চেষ্টা হলে ভারতের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের, কিন্তু তা শুধুই বছরের যে সময়ে বর্ষা থাকে না, সেই সময়টুকুর জন্য। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাই গত জানুয়ারি মাসে ব্রহ্মপুত্রের বুকে চিনের এই বাঁধ তৈরি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের উপরে নির্ভরশীল গোটা বাস্তুতন্ত্রই ভেঙে পড়বে এবং জলসঙ্কটে ভুগবে। তিনি আরও দাবি করেন, এই বাঁধ তৈরি হলে অসমকে অরুণাচল প্রদেশ এবং ভুটানের বৃষ্টির জলের উপরে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। ভারতের এই উদ্বেগের বিষয়টি কূটনৈতিক মাধ্যমে চিনকে জানানো হয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন হিমন্ত।

চিনের বাধ্যবাধকতা
হংকংয়ের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর দাবি অনুযায়ী, তিব্বতের যে অংশে চিন এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করেছে, সেটি অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ। ওই এলাকায় বড়মাপের কোনো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করলে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও ভাবাচ্ছে বেজিংকে। কারণ ওই এলাকায় বড় বাঁধ নির্মাণ করলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে। আর সত্যিই সেরকম কোনো বিপর্যয় ঘটে গেলে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন অববাহিকায় ভয়াল বন্যার আশঙ্কা তৈরি হবে, যা চিনের নিজের স্বার্থের পক্ষেই খুব একটা সুবিধাজনক হবে না।

অন্যদিকে একতরফা ভাবে চিন যদি ব্রহ্মপুত্রে গতিপথ বদলে দেওয়ার বা আটকানোর চেষ্টা করে, তাহলে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আরও অবনতি হবে। যা সার্বিক ভাবে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এবং নিরাপত্তার উপরে প্রভাব ফেলবে। আর ভারতে ব্রহ্মপুত্রের জল আসা আটকালে ভুগতে হবে বাংলাদেশকেও। ফলে ব্রহ্মপুত্রের জল আটকানোর আগে সবদিক ভেবেই মেপে পা ফেলতে হচ্ছে বেজিংকে।

2

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy