আহমেদাবাদের কাছে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার একমাস পর প্রকাশিত Aircraft Accident Investigation Bureau (AAIB)-এর অন্তর্বর্তী রিপোর্ট নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ওই রিপোর্টে ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR) থেকে প্রাপ্ত এক চাঞ্চল্যকর সংলাপ উঠে এসেছে: “Why did you cut off the fuel?” – “I did not do so.” অর্থাৎ, ‘তুমি ফুয়েল বন্ধ করলে কেন? – আমি কিছু করিনি।’ এই সংক্ষিপ্ত সংলাপটি ঘটনার মূল কারণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে। এর পরেই তীব্র দাবি উঠেছে—এই মুহূর্তে যদি বিমানে ককপিট ভিডিও রেকর্ডার থাকত, তাহলে হয়তো দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ আরও সহজে জানা যেত।
অডিও নয়, ভিডিও কেন জরুরি?
বর্তমানে বিমানের ব্ল্যাক বক্সে দুটি রেকর্ডার থাকে: ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (FDR), যা বিমানের সমস্ত প্রযুক্তিগত পরিমাপ রেকর্ড করে, এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (CVR), যা পাইলটদের কথোপকথন ও অন্যান্য শব্দ রেকর্ড করে। কিন্তু ভিডিও রেকর্ডার এখনো অনুপস্থিত। প্রশ্ন উঠছে, বাস, ট্রাক, এমনকি স্কুলবাসেও যখন ক্যামেরা থাকছে, তখন বিমানের মতো উচ্চ প্রযুক্তির যানে ককপিটে ক্যামেরা নেই কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় জোরদার দাবি উঠেছে যে, শুধুমাত্র অডিও নয়, ভিডিও থাকলে হয়তো সন্দেহ বা জল্পনার কোনো অবকাশ থাকত না।
পাইলটদের আপত্তি: নিরাপত্তা বনাম গোপনীয়তা
ককপিটে ভিডিও রেকর্ডার বসানোর প্রধান বাধা মূলত পাইলটদের একাংশ। তাঁদের মূল যুক্তিগুলি হলো:
ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ: ভিডিও রেকর্ডিং পাইলটদের ব্যক্তিগত পরিসরে অনধিকার প্রবেশ করবে বলে তাঁরা মনে করেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাপ: কঠিন মুহূর্তে ভিডিও থাকার চাপ তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
ভুল ব্যাখ্যা: কিছু পরিস্থিতিতে পাইলটরা নিয়ম ভেঙে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন, যা ভিডিও থাকলে ভুলভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে।
পরিবারের আবেগ: ভিডিও ফাঁস হলে দুর্ঘটনায় মৃত যাত্রীদের পরিবারের আবেগ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পাইলটদের সংগঠন ALPA (Air Line Pilots Association), বিশেষ করে আমেরিকায়, দীর্ঘদিন ধরেই এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে লবিং চালিয়ে আসছে।
ককপিট ভিডিও থাকলে কী সুবিধা হতো?
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ককপিট ভিডিও থাকলে বহু সমস্যার সমাধান হতে পারে:
তদন্তের দ্রুততা: ভিডিও থাকলে ঘটনার প্রকৃত কারণ দ্রুত উদ্ঘাটিত হয়, তদন্ত প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
অনিশ্চয়তা ও জল্পনা দূর: অডিওর সঙ্গে ভিডিও থাকলে ঘটনা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানোর সুযোগ কমে।
ভুল দোষারোপ প্রতিরোধ: পাইলটদের ভুলভাবে দোষারোপ করার সুযোগ কমে আসে, কারণ ভিডিওতে তাদের প্রকৃত কার্যকলাপ স্পষ্ট হয়।
কারণ নির্ণয়: ঘটনার জন্য মানুষ, যন্ত্র, নাকি সফটওয়্যারের ত্রুটি দায়ী, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বিষয়টি নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NTSB (National Transportation Safety Board) ১৯৮৯ সালেই ককপিট ভিডিও রেকর্ডার চালুর পরামর্শ দিয়েছিল। ২০০৩ সাল থেকে এটি তাদের ‘Most Wanted’ তালিকায় রয়েছে।
চিন এগোচ্ছে, ভারত কী করবে?
চিন ইতিমধ্যেই দেশীয় তৈরি বিমান COMAC C919-এ ককপিটে ভিডিও নজরদারি চালুর পরিকল্পনা নিচ্ছে। ইউরোপেও এই বিষয়ে কোনো আইনগত বাধা নেই। অথচ মার্কিন FAA (Federal Aviation Administration) এখনো এ বিষয়ে বাধা দিচ্ছে।
এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনার পরে ভারতে পাইলটদের আচরণ, সিস্টেমের ত্রুটি এবং বিভিন্ন জল্পনার মুখে পড়তে হচ্ছে নিহত যাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের। এই প্রেক্ষাপটেই অনেকেই মনে করছেন, এটি ককপিট ভিডিও রেকর্ডার চালুর উপযুক্ত সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিন না একদিন ককপিট ভিডিও রেকর্ডার আসবেই। যেভাবে একসময় CVR (ককপিট ভয়েস রেকর্ডার)-এর বিরুদ্ধে পাইলটদের আপত্তি ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও রেকর্ডারও একইভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করা হচ্ছে।