বিজয়া দশমীর দিনটি যেখানে মা দুর্গার বিসর্জনের বিষাদ নিয়ে আসে, সেখানেই বাঁকুড়ার জয়পুরের বৈতল গ্রাম মেতে ওঠে এক অনন্য উৎসবে— ‘কাদা খেলা’। দীর্ঘদিনের এই ঐতিহ্যকে বজায় রেখে বৃহস্পতিবার বৃষ্টি উপেক্ষা করেই গ্রামের আট থেকে আশি—নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই যোগ দিলেন এই উৎসবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই কাদা খেলার জন্য গ্রামের সাতটি পুকুরের জল দিয়ে ঝগড়ভঞ্জনী দুর্গা মন্দিরের সামনে একটি অস্থায়ী পুকুর তৈরি করা হয়। বিজয়া দশমীর দিন গ্রামবাসীরা সেই কাদা-জলে নেমে বিশেষ খেলা শুরু করেন।
কাদা খেলার নেপথ্যের লোককথা: রাজার প্রতিজ্ঞা
এই কাদা খেলার পেছনে লুকিয়ে আছে এক লোককথা। জনশ্রুতি অনুযায়ী:
- রাজার যাত্রা: একসময় বিষ্ণুপুরের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ বর্ধমানের রাজার সঙ্গে মামলা লড়তে যাওয়ার পথে ঝগড়ভঞ্জনী চণ্ডীর মন্দিরে প্রণাম করেন।
- ছোট্ট মেয়ের আবদার: মন্দির থেকে বেরিয়ে তিনি দেখেন, সামনের বিশাল বটগাছের নীচে একটি ছোট্ট মেয়ে কাদামাটি নিয়ে খেলছে। মেয়েটি রাজাকে দেখে আবদার করে, “আয় খেলবি আয়।” মামলা লড়তে যাওয়ার তাড়া থাকায় রাজা প্রথমে আবদার রাখতে পারেননি। তখন মেয়েটি আধো স্বরে রাজাকে বলে, “মোটে চিন্তা করিস না, জিতে যাবি।”
- প্রতিজ্ঞা পালন: মেয়েটি তখন রাজাকে জিজ্ঞেস করে, “যদি জিতে যাই, তাহলে ফেরার সময় তোর সঙ্গে বসে কাদা নিয়ে খেলব।” রাজা সেই প্রতিশ্রুতি দেন। ঘটনাচক্রে রাজা মামলায় জয়লাভ করেন এবং ফেরার পথে সেপাই-সান্ত্রী নিয়ে মন্দির চত্বরে ওই ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে কাদা খেলায় মেতে ওঠেন।
রোগমুক্তির বিশ্বাস
সেই দিন থেকেই প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিন ঝগড়ভঞ্জনী দুর্গা মন্দিরের সামনে কাদা খেলার প্রথা চলে আসছে বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয়রা। শুধু আনন্দই নয়, এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গভীর বিশ্বাস।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, মন্দির চত্বরে কাদা খেলা শেষে ওই জল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের শরীরে ছোঁয়ালে রোগমুক্তি হয়। শতাব্দী প্রাচীন এই বিশ্বাস আর ভক্তির উপর নির্ভর করেই আজও জয়পুর গ্রামে এই অনন্য প্রথা চলে আসছে।