আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ডামাডোলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন “বাঙালি অস্মিতা” এবং “অনুপ্রবেশ” – এই দুটি শব্দই প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। একদিকে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস যখন ভিন রাজ্যে বাঙালিদের উপর কথিত “অত্যাচারের” প্রতিবাদে পথে নেমেছে, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুর্গাপুরের জনসভা থেকে বাঙালি পরিচয়ের সুরক্ষায় বিজেপির অবিচল অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে কি এই বাঙালি পরিচয়ের সংঘাতই রাজ্যের ভোট যুদ্ধের মূল ইস্যু হয়ে উঠবে?
বুধবার এক বৃহৎ মিছিলের মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের “বাঙালি অস্মিতা” রক্ষার বার্তা দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কলেজ স্কোয়ার থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত এই মিছিল হয়। তৃণমূলের অভিযোগ, ভিন রাজ্যে কর্মস্থলে যাওয়া বাঙালিরা কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে “বাংলাদেশি” সন্দেহে হয়রানি ও আটকের শিকার হচ্ছেন। এমনকি, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) কর্তৃক কিছু বাঙালিকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টার অভিযোগও তোলা হয়েছে, যা বাংলার পুলিশের হস্তক্ষেপে আটকে দেওয়া হয়। ধর্মতলার জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে “গোপন নির্দেশিকা” জারির অভিযোগ তুলে বলেন, “বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন যাকেই সন্দেহ হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দেবেন… বাঙালিরা কি ভারতের অংশ নয়?” তিনি আরও দাবি করেন যে, হাজার হাজার বাঙালিকে আটক করা হয়েছে এবং তাঁদের মধ্যে ২২ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের আধার কার্ড ও আইডি কার্ড থাকা সত্ত্বেও তাঁদের হেনস্থা করা হচ্ছে।
তবে, এই “বাঙালি অস্মিতা”র ইস্যুটি তৃণমূলের একার হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয় বিজেপি। শুক্রবার দুর্গাপুরের সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তৃণমূলের অভিযোগের কড়া জবাব দেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “ভারতের যে যে রাজ্যে বিজেপি সরকারে আছে, সেখানে বাংলা ভাষা ও পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের সম্মান আছে।” প্রধানমন্ত্রী এখানেই থামেননি। তিনি সরাসরি তৃণমূলকে অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার অভিযোগে বিদ্ধ করে বলেন, “এখানে তৃণমূল নিজেদের স্বার্থে বাংলার পরিচয় বাজি লাগিয়ে দিয়েছে। সেই কারণে এখানে অনুপ্রবেশকে বাড়তে দেওয়া হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের ভুয়ো কাগজ বানানো হচ্ছে।” মোদী দাবি করেন, এটি কেবল বাংলার সংস্কৃতি নয়, দেশের সুরক্ষার জন্যও এক গুরুতর হুমকি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের গভীরে ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল দেখছেন। তাঁদের মতে, তৃণমূল যখন বাঙালি পরিচয়ের সুরক্ষা নিয়ে সরব, তখন বিজেপি কৌশলগতভাবে অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তুলে বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “যখন দেশের সামনে তৃণমূলের মুখোশ খুলে গিয়েছে, তখন তারা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য রাস্তায় নেমে পড়েছে।” তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন, “যিনি ভারতের নাগরিক নন, যিনি অনুপ্রবেশ করেছেন, তাঁর সঙ্গে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাঙালি অস্মিতার বিরুদ্ধে হওয়া যে কোনও ষড়যন্ত্রকে বিজেপি সফল হতে দেবে না। এটাই মোদীর গ্যারান্টি।”
এই মুহূর্তে বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল চরম উত্তপ্ত। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস যেখানে বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় নিজেদের অগ্রদূত হিসেবে তুলে ধরছে, সেখানে বিজেপি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা এবং দেশপ্রেমের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি পরিচয়ের এই তীব্র সংঘাত শেষ পর্যন্ত ভোটবাক্সে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেদিকেই এখন সকলের তীক্ষ্ণ নজর।