পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার অদম্য সাহস জুগিয়েছিল যে মহামন্ত্র, তার নাম ‘বন্দে মাতরম’। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলম থেকে নিঃসৃত এই গানটি আজ ১৫০ বছর পূর্ণ করল। কিন্তু দেড়শ বছর পার করেও এই জাতীয় গানকে ঘিরে থাকা বিতর্ক ও রাজনীতি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
সৃষ্টির ইতিহাস ও কালপঞ্জি
গবেষকদের মতে, ১৮৭৪ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে নৈহাটির কাঁঠালপাড়ার জন্মভিটেয় বসে বঙ্কিমচন্দ্র এই গানটি রচনা করেন। পরে ১৮৮২ সালে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এ এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। যদুনাথ ভট্টাচার্য প্রথম সুর দিলেও, ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া সুরেই গানটি প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একাধিকবার এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন।
বিতর্কের শিকড়: পূর্ণাঙ্গ বনাম খণ্ডিত গান
বন্দে মাতরম-এর প্রথম দুটি অনুচ্ছেদ দেশপ্রেম ও প্রকৃতির আরাধনা হলেও, পরবর্তী অংশগুলো নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি তুলেছিল মুসলিম লিগ। তাদের দাবি ছিল, এই গানে হিন্দু দেবীর আরাধনা করা হয়েছে, যা ইসলামি বিশ্বাসের পরিপন্থী। দীর্ঘ বিতর্কের পর ভারতের সংবিধান সভা বন্দে মাতরম-এর প্রথম দুটি অনুচ্ছেদকেই ‘জাতীয় গান’-এর (National Song) মর্যাদা দেয়।
সংসদে মোদি বনাম প্রিয়াঙ্কা: ইতিহাসের নতুন লড়াই
সম্প্রতি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে বন্দে মাতরম নিয়ে শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে তীব্র বাগযুদ্ধ শুরু হয়।
-
প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণ: প্রধানমন্ত্রী মোদি সরাসরি জওহরলাল নেহরুকে দায়ী করে দাবি করেন যে, মুসলিম লিগের চাপের মুখে নতিস্বীকার করে নেহরু বন্দে মাতরম-কে খণ্ডিত করেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে নেতাজিকে লেখা নেহরুর একটি চিঠির উল্লেখ করে বলেন, নেহরু শুধুমাত্র পদ বাঁচাতে জিন্নার আপত্তির প্রতিবাদ করেননি।
-
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর পাল্টা যুক্তি: কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নেহরুর জেল খাটার ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে মোদিকে পালটা তোপ দাগেন। তিনি দাবি করেন, মোদি অর্ধেক চিঠির কথা বলছেন। ১৯৩৭ সালের সেই চিঠিতে নেহরু আসলে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা আরও জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই প্রথম দুটি অনুচ্ছেদ গাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ এটিই ছিল বিপ্লবীদের মন্ত্র।
‘বঙ্কিমদা’ মন্তব্য ও বঙ্গ রাজনীতি
সংসদে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি দুবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করেন। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় তৎক্ষণাৎ এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ঋষি বঙ্কিমকে এভাবে সম্বোধন করা ভুল। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত নিজের ভুল শুধরে নিয়ে তাঁকে ‘বঙ্কিমবাবু’ বা ‘ঋষি বঙ্কিম’ বলতে শুরু করলেও, এই ইস্যুটি বাংলার রাজনীতিতে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল একে ‘বাঙালি জাতির অপমান’ হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে বিজেপির দাবি, প্রধানমন্ত্রী ভালোবেসেই ‘দাদা’ বলেছিলেন, এর মধ্যে কোনো অসম্মান ছিল না।