ঝলমলে আলোয় সেজেছে আলিপুরদুয়ারের কালী মন্দির। চারপাশে সানাইয়ের সুর বুঝিয়ে দিচ্ছে, এ এক বিশেষ বিয়ের আয়োজন! তবে এই বিয়ের বর বা কনে রক্তমাংসের মানুষ নয়, বরং পরিবেশ সুরক্ষার এক অভিনব বার্তা দিতে এখানে গাঁটছড়া বাঁধল ১০০ বছরের এক সুবিশাল বটবৃক্ষ এবং একটি পাকুড় গাছ। ফালাকাটা থানা আবাসন কমিটি ও এলাকার বিশিষ্টজনেরা মিলে এই অভিনব বিয়ের আয়োজন করেন, যেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন প্রায় দেড় হাজার অতিথি।
পরিবেশ সচেতনতার বার্তা:
গাছ লাগানোর বার্তা সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দিতে ফালাকাটা থানা কালী মন্দিরে রবিবার রাতে হিন্দু বৈদিক ও মাঙ্গলিক মতে এই বট ও পাকুড় গাছের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এলাকার মঙ্গল এবং দেশের মঙ্গল কামনায় আয়োজিত এই বিয়েতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়।
নিয়মনিষ্ঠ আয়োজন:
এই গাছের বিয়েতে কোনো নিয়মের ত্রুটি ছিল না। সকাল থেকে জল সইতে যাওয়া, বৃদ্ধি এবং গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়। ছাদনাতলায় পোঁতা হয় কলা গাছ। নিষ্ঠা ভরে মন্ত্রপাঠ, সম্প্রদান পর্ব সেরে শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। কালী মন্দিরের পুরোহিত দীপককুমার রায় ভাদুড়ীর নেতৃত্বে মোট পাঁচজন পুরোহিত এই বিবাহ সম্পন্ন করেন। পুরোহিত মদনগোপাল চক্রবর্তী বলেন, “আমরা পাঁচজন পুরোহিত মিলে বিষ্ণুমতে এবং হিন্দু বৈদিক মতে এই বট ও পাকুড়ের বিয়ে দিলাম। বিয়ের যা যা নিয়ম, সেই সব নিয়মই এই বিয়েতে হয়েছে।”
জমজমাট ভুরিভোজ ও অতিথিদের আপ্যায়ন:
বিয়ের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল বিশাল ভুরিভোজের আয়োজন। শুরুতে বরযাত্রীদের চা-কফি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এরপর ছিল টিফিনের ব্যবস্থা। রাতের মেনুতে ছিল খিচুড়ি, পনির সবজি, পাঁচ তরকারি, চাটনি, পায়েস, আর শেষ পাতে মিষ্টি। প্রায় দেড় হাজার অতিথি পাত পেড়ে এই ভোজ উপভোগ করেন।
উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা ও আবেগ:
ফালাকাটা থানা আবাসন কমিটি এবং ফালাকাটার বিশিষ্টজনেরা প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে থেকেই এই বিয়ের আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলেন। পাত্রপক্ষে ছিলেন শুভব্রত দে, আর পাত্রীপক্ষে নান্টু তালুকদার। দেনা-পাওনার প্রশ্ন না থাকলেও, দু’পক্ষকেই এই বিয়ের আয়োজনের জন্য এলাকার বিশিষ্টজনেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পাত্র পক্ষ শুভব্রত দে বলেন, “খুব ভালো লাগছে। আমরা থানা আবাসন কমিটি এবং বিশিষ্টজনেরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই শতাধিক প্রাচীন বট এবং পাকুড় গাছের মাঙ্গলিক ও হিন্দু বৈদিক মতে বিয়ের আয়োজন করেছি। আমাদের একটাই স্লোগান, গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান।”
পাত্রীপক্ষ নান্টু তালুকদার তাঁর আবেগ প্রকাশ করে বলেন, “মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বাবারা খুব দুঃখ পান, মেয়ে চলে যাচ্ছে ভেবে। তবে আমার খুব আনন্দ লাগছে, কারণ আমার তো কোনো মেয়ে ছিল না, এই বট-পাকুড়ের বিয়েতে মেয়ের বাবা হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।”
ফালাকাটা থানার এএসআই দিলীপ কুমার সরকার এই আয়োজনে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। তিনি জানান, “আমরা এই বিয়ের আয়োজন সাড়ে তিন মাস ধরে করছি। প্রত্যেকে এই বিয়েতে এগিয়ে এসেছে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। থানার অফিসার-সহ সব কর্মীকে এবং ফালাকাটার সকল মানুষকে আমন্ত্রিত করা হয়েছে। বিয়েতে সবাই আসায় বেশ ভালো লাগছে।”
সফলতার ভিন্ন মাপকাঠি:
বিয়ের অনুষ্ঠানে গাছ লাগানোর বার্তা দিতে এদিন বৃক্ষরোপণও করা হয় এবং অতিথিদের ৫০০টি চারাগাছ বিতরণ করা হয়। যাকে বলে মধুরেণ সমাপয়েৎ। তবে, এই বিরাট আয়োজনের সার্থকতা তখনই আসবে, যখন এই বার্তা মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করবে এবং তারা গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবে।