পাকিস্তানের ‘বিশাল তেল মজুত’ নিয়ে ধোঁয়াশা? ট্রাম্পের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি শুধুই ‘স্বপ্ন’? জানুন বিস্তারিত

সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য ও জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে আমেরিকা, যার আওতায় পাকিস্তানের ‘বিশাল তেল মজুত’-এর পরিকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। এই চুক্তি ঘোষণার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন মন্তব্যও করেছেন যে, “কে জানে হয়তো একদিন পাকিস্তান ভারতের কাছে তেল বিক্রি করবে।” কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, পাকিস্তানের তেল মজুত কি সত্যিই এত বড় যে ট্রাম্প এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্তব্য করছেন? এই বক্তব্য এবং পাকিস্তানের তেল মজুত সম্পর্কে ট্রাম্পের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অনেকেই নিছকই ‘স্বপ্ন’ হিসেবে দেখছেন।

ইমরান খানের ফাঁকা বুলি থেকে বিতর্কের সূত্রপাত:

পাকিস্তানে কথিত ‘বিশাল তেল মজুত’-এর এই প্রতারণার সূত্রপাত হয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একটি বক্তব্য থেকে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ইমরান খান পাকিস্তানে সম্ভাব্য তেল মজুত সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, করাচি উপকূলের কাছে ইরান সীমান্ত থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে তেল ও গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু ইমরান খানের এই বক্তব্যের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই পাকিস্তানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক তার দাবিগুলি সম্পূর্ণরূপে খারিজ করে দেয়। তারা জানায় যে, খনন চালিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি এবং এই অঞ্চলে তেলের ভাণ্ডার পাওয়া যায়নি। ২০২৪ সালে পাকিস্তানের একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল যে, এক্সনমোবিল, ইএনআই, পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম এবং তেল ও গ্যাস উন্নয়ন সংস্থা ৫৫০০ মিটার পর্যন্ত খনন করেছে, কিন্তু কোনো তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার খুঁজে পায়নি। পরে একজন কর্তা জানান যে, কোনো কিছুই না পেয়ে খনন কাজ মাঝপথেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের তেলের মজুত: বাস্তব বনাম দাবি:

পাকিস্তান খাইবার পাখতুনখোয়ার কোহাত এবং সিন্ধুর খারোতে তিনটি গ্যাসের ভাণ্ডার এবং খাইবার পাখতুনখোয়ার লাক্কি মারওয়াতেও তেলের ভাণ্ডার থাকার দাবি করেছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল ভাণ্ডারগুলি খনন করতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে এবং এর জন্য প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে।

পাকিস্তানে ‘অসীম তেল মজুত’ থাকার স্বপ্নকে একপাশে রেখে বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশটির আনুমানিক তেল মজুত ছিল ৩৫.৩৫ কোটি ব্যারেল। এটি বিশ্বব্যাপী মোট তেল মজুতের মাত্র ০.০২১ শতাংশ। পাকিস্তানের তেলের বেশিরভাগ ভাণ্ডার বালুচিস্তানে অবস্থিত, যা বালোচ বিদ্রোহীদের আধিপত্যপূর্ণ অঞ্চল।

অন্যদিকে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক ভারতের তেলের মজুত প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বব্যাপী ২৫তম স্থানে রয়েছে এবং বিশ্বের মোট তেল মজুতের প্রায় ০.২৯ শতাংশ।

ইরান থেকে অবৈধ তেল পাচার:

পাকিস্তানে তেলের মজুত অপ্রতুল হওয়ায় এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতি বছর ইরান থেকে ব্যাপকভাবে তেল পাচার করা হয়। ২০২৩ সালে প্রায় ১.০২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইরানি পেট্রোল এবং ডিজেল অবৈধভাবে পাকিস্তানে পাচার করা হয়েছিল। ইরান থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন লিটার তেল পাচার হয় এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য বালুচিস্তানের প্রায় ২৪ লক্ষ মানুষ এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

সম্প্রতি, পাকিস্তানে পেট্রোলের দাম ৫.৩৬ পাকিস্তানি রুপি বেড়ে যাওয়ায় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমে যাওয়ার পরেও দেশে জ্বালানির দাম বাড়া নিয়ে পাকিস্তানিরা অসন্তুষ্ট। সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের ‘বিশাল তেল মজুত’-এর স্বপ্ন এবং মার্কিন-পাকিস্তান তেল চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়ে গেছে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy