দিনের বেলাতেও গা ছমছম করবে! দিঘা থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে এই ‘অজানা’ রাজবাড়িতে লুকিয়ে আছে রানি পিয়ারীমণির রক্তাক্ত ইতিহাস

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নাম বললেই বেশিরভাগের মনে আসে মহিষাদল বা পঁচেটগড় রাজবাড়ির কথা। কিন্তু দিঘা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পটাশপুরের খড়ুইগড় রাজবাড়ির রোমহর্ষক ও রক্তাক্ত ইতিহাস অনেকেরই অজানা। সংস্কারের অভাবে বর্তমানে এই রাজবাড়িটি এতটাই জরাজীর্ণ যে, দিনের বেলা প্রবেশ করলেই গা ছমছম করবে!

খসে পড়ছে পলেস্তরা, বিশাল অট্টালিকাটিকে যেন গিলে ফেলেছে আগাছা আর জঙ্গল। ইট-পাথরের স্মৃতি নিয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজবাড়ির ইতিহাস কিন্তু কম বর্ণময় নয়।

রাজার মুণ্ডু উপহার ও ‘সিংহ গজেন্দ্র’ উপাধি
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে পুরীর গজপতিবংশীয় রাজা দেবরাজের অধীনে তুর্কাচৌর পরগণায় (বর্তমান দাঁতন থানা এলাকা) এক তেলেগু রাজা করদ জমিদার হিসেবে রাজত্ব করতেন। তাঁর রাজধানী ছিল খণ্ডরুইগড়।

কিন্তু তিনি একসময় রাজাকে কর প্রদান বন্ধ করে বিদ্রোহ শুরু করেন।

বিদ্রোহ দমন করতে রাজা দেবরাজ তাঁর সেনাপতি কৃষ্ণদাস মহাপাত্রকে পাঠান।

কৃষ্ণদাস বিদ্রোহী রাজাকে হত্যা করে তাঁর মুণ্ডু উপহার দেন দেবরাজের পায়ে!

এই কাজে কৃতজ্ঞ হয়ে দেবরাজ কৃষ্ণদাসকে সেই জমিদারী দান করেন এবং তাঁকে ‘সিংহ গজেন্দ্র’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এভাবেই এই বংশের ক্ষমতা শুরু হয়।

গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র ও রানি পিয়ারীমণির পলায়ন
এই বংশের পরবর্তী রাজা ছিলেন পঞ্চানন। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত খড়ুই মহালটি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নীলকণ্ঠের শিশুপুত্র কৈলাশচন্দ্রকে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র।

পঞ্চাননের মৃত্যুর পর রাজা কালীপ্রসন্ন শিশু কৈলাশচন্দ্রকে গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করেন।

দাসীর মুখে সেই ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে নীলকণ্ঠের পত্নী রানি পিয়ারীমণি রাতের অন্ধকারে শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে খড়ুই পালিয়ে আসেন।

১৮৬০ সালের সেই রাতে কালীপ্রসন্নের ঘাতকদের মুখোমুখি হয় খড়ুইর সাধারণ মানুষ। তারা রাজপুত্রের প্রাণ রক্ষায় বুক চিতিয়ে লড়ে ঘাতকদের পরাজিত করে। এই সাহস ও ভালোবাসার পরই নতুন রাজার হাতে সেজে ওঠে খড়ুই।

খড়ুইগড় ও তার ধ্বংসাবশেষ
এই ঘটনার পর নির্মিত হয় বিশাল রাজপ্রাসাদ, হাতিশাল, ঘোড়াশাল, কাছারিঘর, ফোয়ারাযুক্ত উদ্যান ও দুর্গা দালান। রাজবাড়ির একাংশে পূজিত হতেন কুলদেবতা রাধাবল্লভ জিউ। চারপাশে খোঁড়া হয় গভীর পরিখা বা সায়র, আর সেখান থেকেই এই স্থানের নাম হয় খড়ুইগড়।

আজ শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে। সিংহ গজেন্দ্র বংশের বিশাল অট্টালিকা, রণ সায়র-এর বাঁধানো ঘাট, দুর্গা দালান—সব কিছুই ধ্বংসের পথে। অনাদর আর পুরু শ্যাওলার নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের দাবি, সঠিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলে ইতিহাসের সাক্ষী এই খড়ুইগড় রাজবাড়িটিও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy