পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধনের স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন (SIR) প্রক্রিয়া শুরু হতেই যেন গোটা রাজ্যে ঘটনার ঘনঘটা। কেন্দ্রীয় সরকার বা নির্বাচন কমিশন সরাসরি NRC (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস) নিয়ে কোনো কথা না বললেও, সীমান্ত থেকে জঙ্গলমহল পর্যন্ত বহু মানুষ SIR-কে NRC-এর প্রথম ধাপ ভেবে চরম আতঙ্কে ভুগছেন। এই পরিস্থিতিতে একের পর এক বিতর্ক, আত্মহত্যার ঘটনা ও ভোটারদের উধাও হয়ে যাওয়ার খবরে SIR প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে।
সীমান্ত জুড়ে আতঙ্ক: ফিরে যাওয়ার হিড়িক
সবচেয়ে বিচিত্র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকাগুলিতে। SIR প্রক্রিয়া শুরু হতেই নথিহীনভাবে ভারতে বসবাসকারী বহু বাংলাদেশি নাগরিক বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার জন্য ভিড় করছেন।
-
বিশাল আটক: সোমবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের কাছে হাকিমপুর চেকপোস্টে প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশি নাগরিক (পুরুষ, মহিলা ও শিশু) একসঙ্গে দেশে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় বিএসএফের হাতে আটক হন। SIR চলাকালীন আইনি ব্যবস্থার আশঙ্কায় তাঁরা পালাচ্ছিলেন।
-
স্বীকারোক্তি: আটক ব্যক্তিরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ভারতে বাস করে ভ্যান চালানো, ইটভাটায় কাজ সহ নানা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কেউ কেউ ২০ বছর ধরে ভারতে ছিলেন।
-
ভোটার উধাও: নদীয়ার সীমান্তবর্তী মুসলিম পাড়ায় BLO পৌঁছতেই বহু ভোটার বাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন বলে খবর। এই ভোটাররা আগে ভোট দিলেও এখন SIR ফর্ম নিতে কেউই বাড়িতে নেই।
⚠️ কাজের চাপ ও আতঙ্কে BLO-দের বিক্ষোভ-আত্মহত্যা
মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ এবং সাধারণ মানুষের আতঙ্ক, সব মিলিয়ে BLO-রা নিজেরাই বিপর্যস্ত।
-
আত্মহত্যা: জলপাইগুড়ির মালবাজার থেকে খবর, শান্তিমণি এক্কা নামে এক মহিলা BLO অতিরিক্ত মানসিক চাপে আত্মঘাতী হয়েছেন। পরিবারের দাবি, SIR-এর কাজ করতে রাজি না হওয়ায় কমিশন তাঁকে জোর করছিল।
-
বিক্ষোভ: রামপুরহাটে বহু BLO ডেটা এন্ট্রি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা এই কাজের জন্য প্রশিক্ষিত নন। অনেকের কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থায়ী ইন্টারনেট সংযোগ নেই, ফলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
📊 কমিশনের হাতে ৩৪ লক্ষ ‘মৃত’ ভোটারের তথ্য!
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, রাজ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষকে এনুমারেশন ফর্ম বিলি করা হয়ে গিয়েছে এবং এবার ফর্ম জমা নেওয়া শুরু হবে। এর মধ্যেই একটি বড় তথ্য সামনে এনেছে UIDAI।
UIDAI-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩৪ লক্ষ আধারধারী নাগরিককে ‘মৃত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, ১.৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড থাকলেও তাঁদের কখনও আধার কার্ড ছিল না। এই বিশাল সংখ্যক নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে।
🚩 রাজনৈতিক বিতর্ক ও অন্যান্য ঘটনা
১. পুরপ্রধানের নামে ২ EPIC: বারুইপুর পুরসভার চেয়ারম্যান শক্তি রায়চৌধুরীর নামে দু’টি EPIC কার্ড থাকার ঘটনায় নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। তাঁর নামে দু’টি SIR ফর্মও এসেছে। তিনি এটিকে কমিশন ও তৃণমূলকে বদনাম করার চক্রান্ত বলে দাবি করেছেন। ২. ক্লাবে SIR কাজ: বিজেপি অভিযোগ করেছে, পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ক্লাব ও কমিউনিটি হলে SIR-এর কাজ চলছে। ৩. জঙ্গলমহলে আতঙ্ক: জঙ্গলমহলের দুর্গম শবর গ্রামগুলিতে SIR ফর্ম পৌঁছতেই নিরক্ষর আদিবাসীদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, ফর্মে সামান্য ভুল হলে সরকারি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। ৪. ভোটাধিকার সঙ্কট: জয়নগরে তিন–চার পুরুষ ধরে থাকা শতাধিক বাসিন্দার ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নাম নেই, প্রয়োজনীয় নথিও নেই। SIR নিয়ে তাঁরা তীব্র আতঙ্কে। তৃণমূল আশ্বাস দিলেও বিজেপি বলছে, তৃণমূল মিথ্যা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
SIR নিয়ে কমিশনের কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে BLO-দের ওপর চাপ এবং সাধারণ মানুষের NRC-জনিত আতঙ্ক পশ্চিমবঙ্গে গোটা প্রক্রিয়াটিকে একটি জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে।