একসময় ছিল যখন কোলাহলে মুখরিত থাকত তুফানগঞ্জ টাউন বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দা। সাদা-নীল ইউনিফর্মে ভরে থাকত ক্লাসরুম। অথচ আজ সেখানে শুধুই নীরবতা। রাজ্যের অন্যতম প্রাচীন এবং একসময়ের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে পুরোপুরি পড়ুয়াশূন্য। এই চিত্র শুধু একটি স্কুলের গল্প নয়, এটি রাজ্যের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তুফানগঞ্জ পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে এই বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করেছিল। একটা সময় এর ছাত্রসংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই স্কুল থেকেই বহু চিকিৎসক, আইনজীবী এবং শিক্ষাবিদ তৈরি হয়েছেন, যারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ১৯৯৫ সালের শিক্ষক দিবসে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ভানুপ্রকাশ দে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সম্মান গ্রহণ করেছিলেন, যা বিদ্যালয়ের মুকুটে এক উজ্জ্বল পালক যুক্ত করেছিল। আজ তিনি শয্যাশায়ী, আর তার প্রাণের প্রিয় স্কুলটি ধুঁকছে।
যা ছিল গর্বের, আজ তা বিস্মৃতির পথে
নিজের হাতে গড়া স্কুলের এমন পরিণতি দেখে ব্যথিত ভানুপ্রকাশ দে কষ্ট নিয়ে বলেন, “সুস্থ থাকলে এই স্কুলটা বন্ধ হতে দিতাম না।” গত বছর এই স্কুলে মাত্র দুজন পড়ুয়া ছিল। এই বছর এপ্রিলের পর সেই সংখ্যা নেমে আসে একজনে, এবং পরবর্তীতে সেই ছাত্রটিও অন্য স্কুলে ভর্তি হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন মাত্র একজন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই বিদ্যালয়ে পরিকাঠামোর কোনো অভাব নেই। মনীষীদের ছবি, শিক্ষামূলক বাণী, সুপরিসর শ্রেণিকক্ষ—সবকিছুই বিদ্যমান। তবুও নেই পড়ুয়া। শিক্ষকের অভাব এবং পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপটই কি এর জন্য দায়ী, এই প্রশ্ন উঠছে বারবার।
কর্তৃপক্ষের আশ্বাস, সাধারণ মানুষের উদ্বেগ
প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান রজত বর্মা জানিয়েছেন, “নতুন শিক্ষক নিয়োগের চেষ্টা চলছে। স্কুলটিকে আবার আগের অবস্থায় ফেরাতে চাই আমরা।” যদিও কর্তৃপক্ষের এই আশ্বাস সাধারণ মানুষকে খুব বেশি স্বস্তি দিতে পারছে না। তাদের মনে প্রশ্ন, একটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত স্কুল যদি এই পরিণতি দেখে, তবে রাজ্যের অন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ কী? কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে সরকারি স্কুলের প্রতি আস্থা?
তুফানগঞ্জ টাউন বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই করুণ দশা শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এক গভীর ক্ষতকে সামনে তুলে ধরেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত এবং সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা।