গঙ্গা ভাঙনে ভিটে হারানোর আতঙ্ক, নদীয়ার নদীতীরবর্তী জীবন-মরণ সমস্যা

ভাগীরথী নদীর করাল গ্রাসে ক্রমশ বিলীন হচ্ছে নদীয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার নদীতীরবর্তী জনপদ। নদীর জল বিপদসীমা ছাড়িয়ে বসতবাড়ির উঠোন পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, যা এলাকার হাজার হাজার পরিবারকে চরম উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আর কয়েকদিনের মধ্যেই অনেক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সর্বহারা হওয়ার আতঙ্কে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে থাকা পরিবারগুলো। অসহায় গ্রামবাসীরা বলছেন, “মৃত্যু ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”

নদীয়ার নাকাশিপাড়া, নবদ্বীপ, শান্তিপুর, রানাঘাট, চাকদা থেকে কল্যাণী পর্যন্ত ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে হাজার হাজার পরিবারের বসবাস। প্রতি বছর বর্ষাকালে নদীর জলস্তর ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়, যা এই এলাকার বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তার উপর দীর্ঘদিনের গঙ্গা ভাঙন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ভাঙন এতটাই তীব্র যে নদী একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। গ্রামবাসীরা জানেন, এবার পাড় ভাঙলে তাঁদের ভিটে-মাটি সবকিছুই নদীবক্ষে তলিয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন ভিটে হারানোর চরম আতঙ্ক, অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের মিথ্যা আশ্বাসে ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী। তাঁদের অভিযোগ, প্রতি বছর ভোটের আগে জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় এসে গঙ্গার পাড় পাকাপোক্তভাবে বাঁধানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ভোট মিটলেই সেই প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকে, কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেউ আর মুখ ফিরিয়ে তাকান না।

গ্রামবাসী চায়না সরদার বলেন, “প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়, তাতে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গঙ্গা বাড়ির কাছে চলে এসেছে, এবার সব তলিয়ে যাবে। জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে কোনও লাভ হয়নি, দুটো বস্তা ফেলে চলে যায়। কিছু হয় না। এভাবেই আমাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করতে হবে। মরে গেলে যাব। গঙ্গা ভাঙন আটকানোর ফের দাবি জানাব, জানি না হবে কি না কিছু।” আরেক বাসিন্দা বৈশাখী সরদার বলেন, “আমরা খুব ভয়ে আছি। আমরা বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব? আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। প্রত্যেক বছর প্রতিশ্রুতি মেলে, কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমরা যেখানেই ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি। কংক্রিটের পাকাপোক্ত পাড় চাই আমরা।”

এই বিষয়ে বিজেপি নেতা সোমনাথ কর অভিযোগ করেছেন, “দিন দিন গঙ্গা ভাঙন বাড়ছে। এত বছর ধরে এতজন জনপ্রতিনিধি এল গেল, কারও ভাঙন নিয়ে হেলদোল দেখলাম না। সাময়িকভাবে ঠেকনা দিয়ে রাখা হয়েছিল। একাধিকবার সংসদে আমাদের রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার এ বিষয়ে প্রস্তাব রেখেছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের উদাসীনতার ফলে সেইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত করা সম্ভব হচ্ছে না।”

অন্যদিকে, বিজেপির তোলা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন শান্তিপুর বিধানসভা তৃণমূল বিধায়ক ব্রজকিশোর গোস্বামী। তিনি পাল্টা মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে বলেন, “একাধিকবার এ বিষয়ে কেন্দ্র সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। গঙ্গার পাড় বাঁধানোর বিষয়ে যেহেতু প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়, আর এ বিষয়টা সম্পূর্ণ কেন্দ্র সরকারের তত্ত্বাবধানে। কেন্দ্র সরকার কোনো সাহায্য না করার কারণে পাকাপোক্তভাবে গঙ্গা বাঁধানো যাচ্ছে না।”

রাজনৈতিক চাপানউতোর চললেও, ভাগীরথীর তীরে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা আজ চরম অনিশ্চয়তায়। সরকারি উদাসীনতা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগের মুখে দাঁড়িয়ে এই মানুষগুলো শুধু ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy