কাঁওয়ার যাত্রা ঘিরে দিল্লিতে আমিষ নিষিদ্ধের নয়া ফতোয়া, ধন্দে দোকানিরা

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ না করলেও, দিল্লিতে নবনির্বাচিত বিজেপির রেখা গুপ্তা সরকারের দায়িত্ব হাতে নিয়েই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) বিতর্কিত এক অভিযান শুরু করেছে। আগামী ১৪ জুলাই থেকে শুরু হতে চলা শ্রাবণ মাসভর কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে মাছ-মাংস সহ আমিষ দোকান বন্ধ রাখা নিয়ে রাজধানী এখন এক অদ্ভুত রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের শিকার। যেখানে সরকার বা পুলিশ কোনো নির্দেশিকা জারি করেনি, সেখানে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি নিজেই ‘সনাতনী সার্টিফিকেট’ বিতরণ করে আমিষ নিষিদ্ধের ফতোয়া জারি করছে।

উত্তরপ্রদেশের পথে দিল্লি?
উত্তরপ্রদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, কাঁওয়ার যাত্রা উপলক্ষে আগামী ১০ জুলাই থেকে রাজ্যের মাংসের দোকান বন্ধ রাখতে হবে, যাতে জলযাত্রীদের পথের দুধারে কোথাও মাংস বিক্রি না হয়। এই সিদ্ধান্তের পথ ধরেই দিল্লির নতুন সরকারের মন্ত্রী কপিল মিশ্র এক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেছেন, কাঁওয়ার যাত্রার সময় রাজধানী ও সংলগ্ন এলাকাতেও কোনো মাংসের দোকান খোলা যাবে না। মিশ্রের দাবি, দিল্লির বেশিরভাগ মাংসের দোকানই নাকি অবৈধ।

তবে, এই দাবির বিপরীতে দিল্লি পুলিশের তরফে এখনও কোনো নির্দেশিকা জারি হয়নি। কোন রাস্তা দিয়ে কাঁওয়ার যাত্রীরা যাবেন, তাও পুলিশ জানায়নি। উল্লেখ্য, দিল্লি পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দফতর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু কাঁওয়ার জলযাত্রীরা দিল্লির প্রায় সব রাস্তা ধরেই যান।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘সনাতনী সার্টিফিকেট’ অভিযান:
সরকার বা প্রশাসনের কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশিকা ছাড়াই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা কাঁওয়ার যাত্রাপথের দুধারের দোকানিসহ প্রায় সব দোকানে গিয়ে ‘সনাতনী সার্টিফিকেট’ দেওয়ার অভিযান শুরু করেছে। তাদের দাবি, শিবঠাকুরের এই আপন দেশে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতি বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই মাসে যাতে সব দোকানে নিরামিষ খাবার বিক্রি করা হয়, সেই লক্ষ্যেই এই সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। এই সার্টিফিকেট দোকানের সামনে ‘চোখে দেখা যায় এমনভাবে’ টাঙিয়ে রাখতে হবে বলেও নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

একটি হিন্দি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভিএইচপি কর্মীরা ১৫০টি দল গঠন করে দিল্লির ১৭৩টি ব্লকে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে। তারা বেশিরভাগ রেস্তরাঁ, মুদির দোকান এবং হোটেলে গিয়ে স্টিকার সেঁটে দিচ্ছে। এর আগে ভিএইচপি কর্মীরা দোকান-রেস্তরাঁয় ঢুকে মালপত্র ও গুদামঘর ঘেঁটে দেখে নিচ্ছেন যে, সেখানে কোনো আমিষ দ্রব্য রয়েছে কিনা। এই স্টিকারটি নাকি প্রমাণ করবে যে, এটি একটি ‘সনাতন হিন্দু দোকান’, যেখানে ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনে বিকিকিনি হয়। ভিএইচপি-র রাজ্যমন্ত্রী সুরেন্দ্র গুপ্তা বলেন, এই অভিযানের সদুদ্দেশ্য হল বিশুদ্ধতার মান বজায় রাখা। এই অভিযান গোটা জুলাই মাস পর্যন্ত চলবে এবং প্রায় ৫০০০ দোকান পরিদর্শনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে হিন্দু সংগঠনটি।

পুরসভার স্পষ্ট অবস্থান, তবে ধন্দে দোকানিরা:
এই বিতর্কের মধ্যেই বৃহস্পতিবার দিল্লি পুরসভা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ১৯৫৭ সালের আইনে পুণ্যার্থীদের জন্য মাংসের দোকান বন্ধ রাখার কোনো বিধি নেই। ফলে কাঁওয়ার যাত্রাপথেও কোনো মাংসের দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ পুরসভা দিতে পারবে না। একইসঙ্গে কাঁওয়ার যাত্রীদের জন্য যেসব সুযোগসুবিধামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও জানিয়ে দিয়েছে পুরসভা।

পুরসভার এই অবস্থানের পরেও দোকানদার ও বাসিন্দারা চরম ধন্দে রয়েছেন। কোনো দোকানদারই এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো নোটিস হাতে পাননি বা প্রশাসনের তরফে কোনো নির্দেশও দেওয়া হয়নি। দিল্লির নিজামুদ্দিন এবং গাজিপুর (যা দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানা ঘেঁষা এবং জাতীয় সড়কের লাগোয়া) হলো প্রধান মাংসের বাজার এলাকা। মন্ত্রী কপিল মিশ্রের দাবি সত্ত্বেও এই এলাকার অনেক দোকানি বলছেন, তাদের দোকানগুলো কোনোটিই অবৈধ নয় এবং পুরসভার অন্দরেই রয়েছে। অনেকেই রশিদও দেখাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও, যদি সরকার চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়, তাহলে মাসভর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ রাখলে তাদের কীভাবে চলবে, তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দোকানিরা।

এই ঘটনা দিল্লির ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেখানে আইনি নির্দেশিকা অনুপস্থিত, সেখানে একটি বেসরকারি সংগঠনের ফতোয়া কতটা কার্যকর হবে এবং সমাজে কতটা বিভেদ সৃষ্টি করবে, তা নিয়েই এখন দিল্লিতে চলছে জোর আলোচনা।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy