বর্ধমান শহরের বুকে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেনসেন টাওয়ার ক্লক। আঞ্জুমান কাছারি বাড়ির ৪৮ ফুট উঁচু স্তম্ভের উপর স্থাপিত এই চতুর্মুখী ঘড়িটি একসময় ছিল শহরবাসীর সময়ের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং নতুন বহুতল ভবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে এই ঘড়ি এখন অচল, যার কাঁটা থমকে আছে অনেকদিন ধরেই। তবে সম্প্রতি এই ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হয়েছে বর্ধমান পৌরসভা।
জানা যায়, স্মার্টফোনের যুগেও এই ঘড়িটি আজও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে চলেছে। ইতিহাসবিদ সর্বজিৎ যশ জানান, ১৮৯৩ সালে বর্ধমানের তৎকালীন রাজা বিজয় চাঁদ মেহতাব লন্ডনের জে.ডাবলু বেনসেনকে দিয়ে এটি তৈরি করান। সেই সময় বর্ধমানের অধিকাংশ মানুষের কাছে ঘড়ি না থাকায় সকলের সুবিধার জন্য এটি স্থাপন করা হয়েছিল। এমনকি ১৯০৪ সালে কার্জন গেট তৈরি হওয়ার পরও সেখান থেকে ঘড়িটি স্পষ্টভাবে দেখা যেত, কারণ তখন শহরে খুব বেশি দোতলা বাড়ি ছিল না। সময়ের বিবর্তনে শহরের skyline বদলে যাওয়ায় এবং বহুতল ভবন গড়ে ওঠায় ঘড়িটি এখন দূর থেকে আর দেখা যায় না।
ঘড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে ইতিহাসবিদ সর্বজিৎ যশ বলেন, “১৯০৪ সালে যখন কার্জন গেট তৈরি হয়, তখনও পর্যন্ত কার্জন গেট থেকে দাঁড়িয়ে এই ঘড়ি দেখা যেত। এখন প্রচুর দোতলা, তিনতলা বাড়ি হয়ে যাওয়ায় আর দূর থেকে দেখা যায় না ঘড়িটিকে।”
এই ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নকে ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি বর্ধমান পৌরসভার পুরপ্রধান পরেশ চন্দ্র সরকার ঘড়িটি পরিদর্শনে যান। তিনি বলেন, “যা কিছু ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন বর্ধমানে আছে সেগুলি একে একে আমরা পুনরুদ্ধার করে সকলের সামনে তুলে ধরব। তার মধ্যে এই রাজবাড়ির ঘড়িটি অন্যতম।” তিনি আরও জানান, এ বছর কার্জন গেট থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে ঘড়িটি পুনরায় দূর থেকে দেখা যায়। পাশাপাশি, যেসব ব্যবসায়ী বিনা অনুমতিতে অবৈধ নির্মাণ করে ঐতিহ্যকে ঢেকে দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
একসময় বর্ধমানে সময় বোঝার জন্য কামান দাগা হত। সকালে কামান শুনে দিনের শুরু এবং সন্ধ্যায় কামানের শব্দ শুনে দিনের শেষ হতো। সেই সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ছিল এই ঘড়ি, যার ঘন্টাধ্বনি বহুদূর পর্যন্ত শোনা যেত। বর্তমানে ঘড়ির কাঁটা থমকে গেলেও, পৌরসভার এই উদ্যোগ শহরের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তারা আশা করছেন, বেনসেন টাওয়ার ক্লক আবারও তার পুরনো গৌরব ফিরে পাবে এবং বর্ধমানের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে তুলে ধরবে।