যেখানে একসময় রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুলগীতির সুর মূর্ছনা ছড়াত, আজ সেখানে শুধুই ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া গন্ধ। বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এ চলল নজিরবিহীন তাণ্ডবলীলা। উগ্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা লাঠি-পাথর নিয়ে ধানমন্ডির এই সাততলা ভবনে ঢুকে হারমোনিয়াম, তবলাসহ একের পর এক বাদ্যযন্ত্র আছড়ে ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
সুরের ওপর উগ্রবাদের আঘাত
ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদে দেশজুড়ে চলা বিশৃঙ্খলার মাঝেই নিশানায় পরিণত হয় ছায়ানট। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, হামলাকারীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে ভবনটির প্রতিটি কক্ষে ঢুকে পড়ে। বাদ্যযন্ত্র ভাঙার পাশাপাশি সুর, তাল ও ছন্দ লেখা অমূল্য খাতাগুলো ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলাকারীদের চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, “এখানে ভারতীয় সংস্কৃতির কোনও জায়গা নেই।” ### ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? ছায়ানটের ওপর এই আঘাত অনেককেই ষাটের দশকের সেই অন্ধকার সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল, ঠিক তখনই কলিম শরাফীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সংগঠন। সেন্সরশিপের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটই ছিল বাংলাদেশের বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সাংস্কৃতিক চালিকাশক্তি।
ভারত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০১৫ সালে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার ছায়ানটকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। ২০১৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সংগঠনের সভাপতি সন্জীদা খাতুনের হাতে এই সম্মান তুলে দিয়েছিলেন। আজ সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন পরিণতি দেখে শোকস্তব্ধ বিশ্বের শিল্পানুরাগী মানুষ।
বর্তমান পরিস্থিতি
ধানমন্ডি থানার আধিকারিক মিথুন সিংহ জানিয়েছেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও ছায়ানট ভবনটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিরাপত্তার খাতিরে এবং এই ধ্বংসযজ্ঞের জেরে আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের সমস্ত ক্লাস ও কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নিজেই কবুল করেছেন— “বাংলাদেশে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে।” একটি মৃত্যু এবং তার বদলে একটি দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি ধ্বংসের এই রাজনীতি এখন ওপার বাংলাকে এক ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।