আগামিকাল, ৬ ডিসেম্বর। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিতর্কিত ও আবেগমথিত দিন। ১৯৯২ সালের এই দিনেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছিল। ৩২ বছর পর, শনিবার সেই দিনটিকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৈরি হতে চলেছে এক অভূতপূর্ব ও দ্বিমুখী সমীকরণ।
১. কলকাতা: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংহতি দিবস’
-
উদ্দেশ্য: তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামিকাল পালিত হবে ‘সংহতি দিবস’।
-
নেতৃত্ব: রাজনৈতিক মহলের মতে, বিজেপি যখন রামমন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্বের আবেগে শান দিয়েছে, তখন পালটা চাল হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রীতির এই মঞ্চকে বেছে নিয়েছেন।
-
তাৎপর্য: মেয়ো রোডের এই সভায় মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই থাকবেন শাসক দলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শীর্ষ নেতৃত্বের এই জোড়া উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, লোকসভা ভোটের আগে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যাতে কোনোভাবেই নিরাপত্তাহীনতা বা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে দল কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
২. মুর্শিদাবাদ: হুমায়ুন কবীরের ‘বাবরি মসজিদ’ রাজনীতি
-
বিদ্রোহী কর্মসূচী: প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর, যিনি দল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড হয়েছেন, তিনি ঘোষণা করেছেন বাবরি মসজিদের আদলে এক নতুন মসজিদ তৈরির।
-
শিলান্যাস: তিনি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেই ৬ ডিসেম্বরকেই।
-
অনড় অবস্থান: সাসপেনশনের পরেও অনড় হুমায়ুন কবীর বলেছেন, “আমি আমার অবস্থান থেকে একচুলও বদলাইনি। ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানিয়েই আমরা আগামিকাল এই পদক্ষেপ করছি। একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট বললে এই সিদ্ধান্ত থেকে আমি সরে আসতে পারি।”
-
প্রস্তুতি: বেলডাঙা ও রেজিনগরের সংযোগস্থলে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে শিলান্যাসের জোরকদমে প্রস্তুতি চলছে। হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুবাই, সৌদি আরব থেকে মৌলানারা গুজরাত হয়ে আসছেন।
কৌশল ও বিতর্ক:
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারিভাবে হুমায়ুন কবীরের এই কর্মসূচির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে এবং জানিয়েছে যে এই কর্মসূচির দায় দলের নয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই দুই সমান্তরাল কর্মসূচিকে শাসক দলের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি হিসেবে দেখছেন।
-
আইএসএফ-এর প্রশ্ন: পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ও নওশাদ সিদ্দিকীর মতো আইএসএফ (ISF) নেতারা তৃণমূলের এই কৌশলের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে সরকার একের পর এক মন্দির তৈরি করে, তারা কেন মসজিদ তৈরির বিরোধিতা করছে? তাঁরা বলছেন, মসজিদ-হাসপাতাল-বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা সরকারেরই দায়িত্ব।
-
বিশ্লেষণ: বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণে ভাঙন ধরাতে তৎপর বিরোধীরা। তাই একদিকে মমতার সংহতি দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষা, অন্যদিকে হুমায়ুনের মাধ্যমে কট্টরপন্থী সংখ্যালঘু আবেগে প্রলেপ দেওয়া—এটি কি আসন্ন নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু ভোটের রাশ নিজেদের হাতে রাখারই কৌশলী অঙ্গ? প্রশ্ন থাকছেই।
নবান্নের সতর্কতা:
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সতর্ক নবান্ন। মুর্শিদাবাদের ওই এলাকায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তার জন্য পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে। শনিবার ১৮ কোম্পানি বিএসএফ নামানো হবে এবং বিভিন্ন জেলার পুলিশও মোতায়েন থাকবে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার কুমার সানি রাজ জানিয়েছেন, বেলডাঙা ও রেজিনগর এলাকা কার্যত পুলিশের দখলে থাকবে। সংহতি দিবসকে কেন্দ্র করে রাজ্যের কোথাও যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তার জন্য প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে ‘হাই অ্যালার্টে’ রাখা হয়েছে।
সব মিলিয়ে, আগামিকাল, ৬ ডিসেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক ‘অগ্নিপরীক্ষা’র দিন হতে চলেছে।