প্রেশার কুকারের মতো জমে থাকা রাগ, পুরুষের আত্মহত্যার হার মহিলাদের দ্বিগুণ কেন?

স্বামী-স্ত্রী কর্মসূত্রে পরস্পরের থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র তাঁদের সন্তান। কিছুদিন আগে এমনই এক স্বামী তাঁর এক পরিচিত তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলেন, ‘আই অ্যাম আ ফেইলড হাজ়ব্যান্ড অ্যান্ড আ ফাদার…!’ প্রশ্ন করে জানা যায়, অনেক দিন তাঁদের আর দেখাই হয়নি। ভিডিয়ো কলে কথা হলেও দিনের শেষে তা ‘নিয়মরক্ষা’ মাত্র। কিন্তু তিনি নিজেকে ‘টাফ’ প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের মধ্যে গুমড়ে মরছিলেন, যার ফলে চূড়ান্ত রেগে উঠে সকলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছিলেন এবং নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করছিলেন। তবে বহু চেষ্টার পর আত্মজন ও মেন্টাল হেল্থ এক্সপার্টদের সাহায্যে তাঁরা ফের কাছাকাছি এসেছেন।

এই বাস্তব-চিত্রটি কেবল একজনের সমস্যা নয়, বরং কোটি কোটি পুরুষের জীবনের চিত্র। কিন্তু কেন এমন হয়? মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, পুরুষরা আবেগ প্রকাশের ‘ভাষা’ জানেন না, কারণ তা তাঁদের ছোট থেকেই শেখানো হয়নি। ফলে নিজেকে ‘নিস্পৃহ’ বা ‘রাফ ও টাফ’ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে তাঁরা নিজেদের আঘাতের রাস্তা বেছে নেন, যার চূড়ান্ত পর্যায় আত্মহত্যা।

আবেগ নয়, রাগকে আঁকড়ে ধরা:

প্রায় ২৫ বছর ধরে পুরুষ মন নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী দীপ পুরকায়স্থ-এর কথায়, “যেহেতু আবেগের ভাষা না জানা, না আছে প্রকাশের অভ্যাস, তাই রাগকে তাঁরা সব কিছুর জন্য আঁকড়ে ধরছেন। নিজের উপরে তা প্রাণঘাতী হিসেবেও প্রয়োগ করছেন। আত্মহত্যা হিংসার এমন একটা রূপ যার জন্ম রাগ থেকে।”

একটি বেসরকারি হাসপাতালের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর ও থেরাপিস্ট দীপের কথার রেশ টেনে বলেন, “পুরুষের আত্মহত্যার ধরন অনেক বেশি হিংসাত্মক। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, মেয়েরা সুইসাইডের চেষ্টা বেশি করেন, কিন্তু পুরুষরা এতটাই ‘লেথাল’ (প্রাণঘাতী) ভাবে তা চেষ্টা করেন যাতে আর বাঁচার উপায় না থাকে।”

‘প্রেশার কুকারে’র উদাহরণ ও পুরুষত্বের চাপ:

কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শতভিষা চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন—প্রেশার কুকারের উদাহরণ টেনে।

  • ব্যাখ্যা: “আমাদের সমাজ এমনভাবেই স্ট্রাকচার্ড যেন পুরুষ ও আবেগ—এক পথ ধরে না হাঁটে। কিন্তু আবেগ তো জেন্ডার আইডেন্টিটি দেখে তৈরি হয় না। ফলে সেই সব আবেগ ছেলেরা ধামাচাপা দিতে বদ্ধপরিকর।”
  • বিস্ফোরণ: তিনি আরও বলেন, “মনের উপরে গভীর প্রভাব ফেলে এমন অনেক কিছুকে অধিকাংশ পুরুষ অত্যন্ত নিস্পৃহ ভাবে দেখান বা ‘ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট’ বলে এড়িয়ে যান। আর প্রেশার (আবেগ) জমে বেরনোর পথ না পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটে, অর্থাৎ মৃত্যুই বেছে নেন তাঁরা।”
  • তাই এই বিষয়টা ‘অনিচ্ছা’ নয়, বরং এক ধরনের ‘মেল ইগো’ এখানে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে।

সাহায্য চাওয়া মানে পরাজয়:

ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির ‘সোশিও-সাইকোলজি’র সহকারী অধ্যাপক মায়াঙ্ক কুমার বলেন, “এটি সামাজিক ভাবে আরোপিত এক প্রতিরক্ষামূলক দেওয়াল/অসহায়তার মুখোশ, যেখানে পুরুষদের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় যে সব তাঁকে নিজেকে সামলাতে হবে। ফলে কোনো সাহায্য চাওয়া তাঁদের কাছে পরাজয়।” সেই চাপ যখন নিজে সামলাতে পারেন না, তখন এই আত্মগ্লানিই শেষমেশ আত্মবিনাশে নিয়ে যায়।

ওই থেরাপিস্টের সংযোজন, “ছেলেদের শেখানো হয় কাঁদলে তা ম্যাসকুলিনিটির সঙ্গে ম্যাচ করে না। তাই মন খুলে কথা বলাকেও দুর্বলতা মনে করে নিজের উপরে চাপ বাড়াতে থাকেন।”

বিশ্বজুড়ে পুরুষদের আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ:

এই সামাজিক চাপ ও পিতৃতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পড়ে বেড়ে চলে পুরুষদের আত্মহত্যা। আমাদের দেশেই শুধু নয়, বিশ্বজুড়েই পুরুষদের আত্মহত্যার হার মহিলাদের নিরিখে অনেক বেশি।

  • সর্বশেষ প্রকাশিত এনসিআরবি-র ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া, ২০২৩’ রিপোর্ট বলছে, মোট আত্মহত্যার ৭২.৮ শতাংশ পুরুষ, যার মধ্যে ৬৮.১ শতাংশ বিবাহিত
  • ২০২৪-এ প্রকাশিত ‘হু মর্টালিটি ডেটাবেস’-এর তথ্য বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৭ লক্ষ মানুষ আত্মঘাতী হন। তার মধ্যে মহিলাদের তুলনায় পুরুষের আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ

‘বর্ন ফাইটার’ নারী ও ‘দমনকারী’ পুরুষ:

বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দীপ পুরকায়স্থ ভাগ করে নিয়ে জানালেন, ঠিক এই জায়গাতেই নারী-পুরুষের বিষয়টা আলাদা হয়ে যায়।

  • পুরুষ: ছেলেরা পিতৃতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে লড়তে পারেন না বা চান না। তাই নিজের উপরে আঘাত করেন। পুরুষদের শেখানো হয় স্থির থাকতে, আবেগ লুকিয়ে রাখতে, যন্ত্রণা সহ্য করতে। এই দমনই মানসিক ভাবে তাঁদের দুর্বল করে তোলে।
  • নারী: মেয়েদের বড় করা হয় ‘ইমোশনাল ভোকাবুলারি’ শিখিয়েই, যাতে কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর মতো ক্ষমতা তৈরি হয়। মেয়েরা ‘সহজে কাঁদে’ যেন সমাজের কাছে স্বাভাবিক। তাই চোখের জল মুছে তাঁরা ফের পরের লড়াইয়ে নামেন।

শতভিষার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, পুরুষের ক্ষেত্রে কান্না জমতে থাকে। সেই দুঃখ যখন বহিমুর্খী হয়, তখন তা আগ্রাসী মন বা হিংসার প্রকাশ। আর অন্তর্মুখী হলে তা অবসাদ, যা প্রকাশের অর্থ দুর্বলতা। এই দুই-এর মিশেলে ‘শক্তিশালী’ পুরুষ তাঁর নিজের কোমল সত্তার কাছে হার মেনে চরম সিদ্ধান্ত নেন।

তাই মহিলারা ‘বর্ন ফাইটার’ আর পুরুষরা ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’—এমন সহজ অঙ্ক দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিচার করা ঠিক নয়। বিশ্বজুড়ে পালিত ‘মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’-এ সকলের আহ্বান—কণ্ঠ ছাড়ো জোরে (Express your feelings strongly)।

Related Posts

© 2025 Tips24 - WordPress Theme by WPEnjoy